পুঁজিতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ‘নারীমুক্তি’ অসম্ভব
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০১৭, ১৪:১৮
৮ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৯১১ সালের ৮ মার্চ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও পালন হবে 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। বাংলাদেশে বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, গণসংগঠন এবং এনজিও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে। সারাবিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশের নারীসমাজ আজও ‘মানুষ’ হিসেবে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। পুঁজিতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মানুষের কোনো ধরনের মুক্তি সম্ভব না। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন না করে নারীমুক্তি হাস্যকর বিষয়।
নারী দিবসের জন্ম ইতিহাস:
নারী দিবসের প্রাক্কালে খুব স্বাভাবিকভাবে মনে পড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা সংগঠক মার্কসবাদী জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেতা ক্লারা জেটকিনকে। মানুষের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও চিন্তাভাবনার দিক থেকে গভীর বিশ্লেষণী এবং প্রচণ্ড সাহসী ছিলেন কমরেড ক্লারা। মাত্র ষোল বছর বয়সে ১৮৭৪ সালে জার্মানির নারী আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তখনকার দিনে জার্মান মেয়েদের শুধু নয় সারাবিশ্বেই মেয়েদের পড়াশুনার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি হয় নি। এত সব অসুবিধা, বাধা-বিঘ্ন থাকা সত্ত্বেও ক্লারা জেটকিন নিজের যোগ্যতা বলে, যুক্তির বলে নেতৃত্ব লাভ করেন। তাঁর চেতনায় ছিল, কিভাবে সমাজের নারীকে মর্যাদার শিখরে পৌঁছানো যায়। সেসময় নারী শ্রমিকদের উপর চলত অপাশবিক নির্যাতন। রাতদিন প্রায় ১৩-১৪ ঘণ্টা শ্রম করতে হতো। নারী শ্রমিক হওয়ার কারণে পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় বেতন ছিল খুব সামান্য, যার ভয়াবহ জের আজ অব্দি বিরাজমান। ক্লারা জেটকিন মনে করতেন, প্রত্যেক নারীই ‘মানুষ’। তারা মানুষের মর্যাদা পাবেন, কোনো ধরনের বৈষম্য, নিপীড়ন, শ্রমশোষণ চলবে না। তিনি মনে করতেন, বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিশীল চর্চার মধ্যদিয়েও সমাজের ভেতর একটা সংস্কৃতিগত প্রগতিশীল রূপান্তর আনা যেতে পারে। সে প্রচেষ্টাই আজীবন চালিয়েছেন কমরেড ক্লারা জেটকিন।
প্রথম প্যারিস শ্রমিক সম্মেলনে তিনিই প্রথম শ্রমজীবী নারীর সকল ধরনের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। ক্লারা জেটকিন বলেন এবং যুক্তি দিয়ে বোঝান যে, পুরুষ শ্রমিকের যে কোনো ধরনের বঞ্চনার মূলে রয়েছে পুঁজিপতিরা। নারীর জন্য যদি তার কর্মসঙ্কোচন বা মজুরি হ্রাস হয় তার জন্যেও পুঁজিপতিরাই দায়ি এবং মুক্তির উপায় নারী-পুরুষ শ্রমিকের যৌথ আন্দোলন; নারীর প্রতি দোষারোপ নয়। ক্লারা নারীকে বঞ্চিতদের দলভুক্ত করেছেন। সুতরাং নারীকে দলে টানলেই সমাজতন্ত্র জয়ী হবে। তিনিই বলেন যে, নারীদের প্রশ্ন কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। সামাজিক শ্রেণি হিসেবে তাদেরকে দেখতে হবে। যেহেতু বুর্জোয়া, পাতি বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত এমনকি সর্বহারা শ্রেণির মেয়েরাও সামাজিক বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার তাই মুক্তির সংগ্রাম তাদের সবার। একথা বলে রাখা দরকার যে, পুরুষ শ্রমিকরা নারী শ্রমিকদের শ্রমে যুক্ত করার পক্ষপাতি ছিলেন না এবং সমাজতন্ত্রীরাও মনে করতেন এতে পুরুষ শ্রমিকদের কাজের বাজার সঙ্কুচিত হবে। ক্লারা জেটকিনই প্রথম যুক্তি দিয়ে তাদের এই ধারণাসুলভ চিন্তাকে খণ্ডান। ওই সম্মেলনে তাঁর এই অমূল্য কথাকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বের মেহনতী মানুষের নেতা, কমরেড লেনিন নারীকে সামাজিক উৎপাদনের কাজে যুক্ত করে গার্হস্থ্য দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবার কথা বলেন। আমাদের প্রত্যেক মানুষের মনে রাখা দরকার যে, ক্লারা জেটকিনের কাছে বিশ্ব নারী সমাজের ঋণ শুধু নয় মানবসমাজের ঋণ অপরিমেয়। তাই তো, ৮ই মার্চের প্রত্যেকটি আলোচনায় প্রাধান্য পান, বিশ্বের নেতা কমরেড ক্লারা জেটকিন।
আমরা ইতিহাস থেকে জেনে থাকি যে, ১৯০৭ সালে সমাজতন্ত্রী নারীদের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় স্টুটগার্ডে। খুব সম্ভবত, ১৫ টি দেশের ৫৯ জন নারী প্রতিনিধি ‘আন্তর্জাতিক নারী সংঘ’ গড়ে তোলেন। যে সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন- মার্কসবাদী নেতা ক্লারা জেটকিন। কিন্তু জেনে রাখা ভালো যে, সম্পাদক নির্বাচিত হয়েও তিনি সংঘের সামান্য মুখপাত্র হয়ে কাজ করে যান। তাঁর মূল লক্ষ্য সমাজতন্ত্র। যা বর্তমান নারীবাদীদের অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে বলে আশা রাখি! এই সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি নারীনেত্রী হলেও, সমাজতন্ত্রী নারী আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে তাঁকে শুরু থেকেই গুরুত্ব দেয়া হতো। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবার পর আন্তর্জাতিক স্তরে নারী আন্দোলনকে প্রসারিত করা তাঁর পক্ষে আরো সহজ হল।
এরপর তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয় কোপেনহেগেনে। এই সম্মেলনে প্রথমে আফ্রিকা ও পরে ব্রিটিশ ও বেলজিয়াম প্রতিনিধিদের সঙ্গে নারীর ভোটাধিকার বিষয় নিয়ে তাঁর মতবিরোধ হয়। ওরা প্রথম পর্যায়ে মেয়েদের সীমিত ভোটাধিকার মেনে নিয়ে পরবর্তীতে সার্বিক ভোটের আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান। কিন্তু বিশ্বের নেত্রী ক্লারা নারী-পুরুষের সার্বজনীন ভোটাধিকারের পক্ষে তীব্র সওয়াল করেন এবং সম্মেলনে তাঁর প্রস্তাবই গৃহীত হয়।
কোপেনহোগেন এ অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় নারী সম্মেলনে ৮ মার্চ হয়ে উঠেছিল ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। একটু পিছনে ফিরলে আমরা জানতে পারি, ১৮৫৭ সালে নারী আন্দোলনের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিল সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা, মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। এই ন্যায়সঙ্গত মিছিলে চলে সরকারি বাহিনীর অমানবিক দমন-পীড়ন-নির্যাতন। যার রূপ নেয় ভয়াবহ আন্দোলন, নারী শ্রমিকদের উত্তাল আন্দোলন। আমরা ইতিহাস ঘেঁটে আরো জানতে পারি, পৃথিবীতে আর কোন মানবিক আন্দোলনকে এমন দীর্ঘমেয়াদী ও চূড়ান্ত ফলাফলহীন অবস্থায় এভাবে অনিশ্চিত দূরগামী সক্রিয়তায় যুক্ত থাকতে হয়নি। এ আন্দোলনকে সংগঠিত রূপ দেন বিশ্বের নেতা, বিশিষ্ট তাত্ত্বিক মার্কসবাদী ক্লারা জেটকিন। যার ফল পায় বিশ্বের নারী সমাজ ১৯১১ সালের ৮ মার্চই ‘প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালনের মাধ্যমে। এটি ছিল একটি আনুষ্ঠানিকতা, কিন্তু এই আন্দোলনের সূত্র আমরা ইতোমধ্যে পেয়েছি। ক্লারা জেটকিনের জন্ম সালে (১৮৫৭) যেদিন নিউইয়র্কের সুচ কারখানার মেয়েরা মানবেতর কর্ম পরিবেশের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ মিছিলে নেমেছিল সেদিনটিও ছিল মার্চ মাসের ৮ তারিখ। এ ঘটনার ৩ বছরের মাথায় শ্রমিক নারীরা ইউনিয়ন গড়েছে। যে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এই সফলতা। একইসঙ্গে স্মরণ করি অগ্নিদগ্ধ ১৪০ জন নারী শ্রমিকের কথা। নিউইয়র্কেরই এক পোশাক কারখানায় ১৯১১ সালের ২৫শে মার্চ এই নারী শ্রমিকদের মৃত্যু আন্দোলনকে আরো ত্বরাণ্বি¦ত করে। ১৯১১ সালের ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা হওয়ার পর ১৯১৩ সালে ৮ মার্চে ইউরোপ জুড়ে র্যালি ও সমাবেশ করেছিল শ্রমিক নারীরা।
নভেম্বর বিপ্লবের পর ১৯২০ সালের ৮ মার্চে রাশিয়ায় আন্তর্জাতিক শ্রমিকদিবস ও নারী দিবস পালিত হয়। এরপর থেকে ৮ মার্চকে প্রতীকি দিন ধরে নিয়ে সারা দেশে দেশে নারীরা পথে নেমেছেন। চীনের নারীসমাজ ১৯৩৬-এর ৮ই মার্চ জাপানী হটাও শ্লোগান নিয়ে মিছিলে নামে। ১৯৩৭ সালে ৮ই মার্চ স্পেনে স্বৈরশাসক ফ্রাঙ্কের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই এ রাজপথে নেমে আসে বিপুল সংখ্যক নারী। ১৯৪৩-এর ৮ মার্চে ভিয়েতনামের নারী পথে নামে ফরাসি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। ১৯৭৯-র ৮ই মার্চে ইরানের নারী পর্দাপ্রথার নামে অবরুদ্ধ করে রাখার চক্রান্তের বিরুদ্ধে নেমে আসে রাজপথে। এইসব সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘ ১৯৭৫-৮৫ নারী দশক ঘোষণা করে। আমরা আরো জানতে পারি, ৮ মার্চকে নিয়ে লীগ অব নেশনস- এ ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছিল ১৯৪০-এর দশকে। ৪০ বছরের নানা ধরনের পর্যবেক্ষণ ও নানা কার্যক্রমের পর আন্তর্জাতিক নারী দিবস জাতিসংঘের স্বীকৃতি অর্জন করে। ২০০৯-এ বিশ্বের ২৯টি দেশে সরকারি ছুটিসহ প্রায় ৬০টি দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়েছে। জেন্ডার সাম্যই যার মূল সূর।
কিন্তু নির্মম হলেও সত্য যে, আজ অব্দি সারা বিশ্বের নারী সমাজ অবহেলিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, নিপীড়িত। নারী শ্রমিকদের ওপর চলে যৌন হয়রানিসহ নানাধরনের নির্যাতন। কোথায় নেই নারী নির্যাতন! বাসে, রাস্তায়, বাড়িতে, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সর্বত্র নারী নিপীড়ন। আমরা জানি, কৃষক নারীদের উপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন - ভোর পাঁচটা থেকে শুরু করে দীর্ঘ রাত অবধি একটানা সন্তান লালন-পালন, কৃষিজমি দেখাশুনাসহ নানা ধরনের কাজ করেন তারা। কিন্তু আজ অবধি কোথাও কৃষক নারীদের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। পুঁজিবাদী সমাজে নারীকে দেখা হয় ভোগের বস্তু হিসেবে। আমাদের নারী সমাজও এর বলি হোন। এ থেকে উত্তরণের পথ সমাজতন্ত্র, মানবমুক্তি। মানবমুক্তির সাথে নারী মুক্তি জড়িত। পুঁজিবাদী, ভোগবাদী সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা অব্যাহত রেখে সারাবিশ্বের মানবমুক্তি আনতে হবে।
জয় মানবতা
জয় সমাজতন্ত্র
লেখক: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট