পুরুষ তুমি একাই নও, মানুষ আমরাও
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০১৭, ২০:৪৩
ফরাসি দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক সিমোন দ্য বোভোয়ার রচিত নারী নিয়ে তার বিখ্যাত বই ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’তে বলেছেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী’।
এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, সিমোন দ্য বোভোয়ার এটা কেমন কথা বললেন! জন্মের পরপরই তো লিঙ্গ দ্বারা নারী-পুরুষ নির্ণয় করা হয়। লিঙ্গই তো প্রমাণ করে কে নারী, কে পুরুষ। তাহলে এ কথার কি কোনো ভিত্তি আছে?
না ভিত্তি নাই। সিমোন দ্য বোভোয়ার’র এ কথার কোনোই ভিত্তি নাই পুরুষ-তন্ত্রের ধারক, বাহকদের কাছে। তবে এ কথার বিশেষত্ব আছে মানবতা-কামীদের কাছে।
লেখক সিমোন’র ওই এক লাইনের কথার ভিত্তি অনেক। যার ভাব ও ব্যাখ্যা ব্যাপক। যা প্রকৃত মানুষকে ভাবতে ও বুঝতে শিখিয়েছে। শুধু তাই নয়, তার ওই কথাটুকু পুরুষ-তন্ত্রের গালে কষে চপেটাঘাতও করেছে।
তবে হ্যাঁ, এ ভাবনা পুরুষ-তন্ত্রের ধারক, বাহকরা ভাবতে পারে না। আসলে এরা এসব ভাবতে চায় না। কারণ, তাদের কাছে নারী মানেই গণিমতের মাল, যৌন-দাসী ও সম্ভোগের বস্তুসহ সন্তান উৎপাদক যন্ত্র মাত্র।
তবে এবার আসা যাক সিমোন’র ওই কথাটুকুর দার্শনিক ব্যাখ্যায়। যৎসামান্য হলেও পুরুষ-তন্ত্রের কিছুটা ব্যবচ্ছেদ করে আমরা দেখে নিই কিভাবে তারা মানুষের সম্মান না দিয়ে যুগ যুগ ধরে ‘নারী’কে নারীতে পরিণত করে রেখেছে।
আমাদের পশ্চাদগামী পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তথা পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থা নারীকে কখনোই পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে দেখে না, মানেও না। এ সমাজ নারীকে মানুষের সম্মান না দিয়ে অবলা, অর্ধাঙ্গিনী রূপে গড়ে তুলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
যদিও জৈবিক-ভাবে এক-একজন স্ত্রী-অঙ্গ নিয়ে জন্মায়— এইটুকুই প্রাকৃতিক সত্য, তা অস্বীকার করছি না। তবে এটুকু কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে, জন্মলগ্ন থেকে কিন্তু একজন শিশু জানতে পারছে না, সে নারী নাকি পুরুষ! অথচ আমরা তাকে শিখিয়ে দিচ্ছি সে নারী।
তাকে পদে-পদে টিপ পড়িয়ে, চুল ঝুঁটি বেঁধে, পুতুল খেলায় অভ্যস্ত করে, রান্নাবাটি দিয়ে, বাইরে বেরোনো বন্ধ করে, নানা কুসংস্করাচ্ছন সংস্কারে বন্দী করে, আলতা-পাউডার-স্নো-সর-হলুদ মাখিয়ে সামাজিকভাবে তাকে ক্রমশ মেয়েলি করে তুলে আমাদের এই পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থা।
তার সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তুমি নারী, তুমি মানুষ নও। তুলে ধরা হয় হাজারটা বিধি-নিষেধ। পুরুষ-তন্ত্র তাকে পই পই করে শিখিয়ে দেয়, এই হচ্ছে তোমার চৌহদ্দি, এর বাইরে তুমি যাবা না। এটুকু মাড়াতে পারবা, অটুকু মাড়াবা না। এমন আরো অনেক কিছু চাপিয়ে দেয়া হয়।
এছাড়াও পুরুষ-তন্ত্রের রয়েছে লিঙ্গের কৃত্রিম ধারণা ও বিভাজন সৃষ্টির মূলে। এই তন্ত্র আগে থেকেই ঠিক করে দেয় কেমন হবে একজন মেয়ের আচরণ, আলাপ-চারিতা, সাহিত্য-দর্শন, গান-কবিতা, হাসি-ঠাট্টা এবং পোশাক পরিচ্ছেদ।
পুরুষতান্ত্রিক সমজে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের মাঝে লিঙ্গদ্বারা এমন বিভাজন চলতেই থাকে। নারীও যে মানুষ, তা এই তন্ত্র স্বীকার করতে যেমন চায় না, তেমন মানতেও চায় না।
পুরুষ শাসিত এই সমাজে আমাদের পুরুষরা পেশীশক্তির বলে নিজেরা সমাজের প্রভুর আসনটিতে অধিষ্ঠিত হয়ে নারীর হাতে-পায়ে পরাধীনতার বেড়ি পড়িয়ে সমাহিত করেছে নিজেদের সম্ভোগের সামগ্রী হিসেবে সেবাদাসী বা পরিচারিকা রূপে। সেই সাথে নারীকে বানানো হয়েছে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র!
পুরুষ কখনোই চাইবে না, নারী মুক্তি। পুরুষ কখনোই মেনে নিবে না, নারী মত প্রকাশ করুক নিজস্ব স্বাধীনতায়। নারী নিজের মত করে সিদ্ধান্ত নিক। নারী ঘর থেকে বেরিয়ে আসুক। সমাজের একটা অংশ হয়ে উঠুক নারী—তা কখনোই চাইবে না পুরুষ-তন্ত্রের ধারক, বাহকরা।
তাই পুরুষ-তন্ত্রের এই নাগপাশ ছেড়ে নারীকেই বেরিয়ে আসতে হবে। কষে লাথি বসাতে হবে পুরুষ-তন্ত্রের অণ্ডকোষে। সেই সাথে প্রমাণ করতে হবে এবং বলতে হবে চিৎকার করে, পুরুষ তুমি একাই মানুষ নও, মানুষ আমরাও।
লেখক: ব্লগার