বুদ্ধির লিঙ্গ বিভাজন হয় না

প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৯:০৫

ইয়ার্কির ছলে হোক কিংবা সিরিয়াস আলোচনায়। আমাকে প্রায়শই একটা ব্যাপার নিয়ে কথা শুনতে হয়। যতই লাফালাফি আর বিদ্রোহ করি না কেন, মেয়েদের সাথে নাকি ছেলেদের প্রচুর তফাত।  

শারীরিক বা বায়োলজিকাল দিক থেকে যে পার্থক্য আছেই সেটা তর্কে স্থান পেতে পারে না। কারণ এটাই হচ্ছে একমাত্র বিশুদ্ধ ভিন্নতা। একজন পুরুষ কখনোই সন্তান ধারণ করতে পারবেন না। কিন্তু সন্তান পালন তো দুজনেই সমান ভাবে করতে পারার কথা। কিন্তু সাধারণত সেটা হয় না, কারণ আমাদের অভ্যস্ত হতে হয়েছে মেয়েদের তথাকথিত ভূমিকা দেখে। কোন যুক্তিগত কারণে নয়। আমার সমস্যা সেখানে, যেসব পার্থক্য জোর করে তৈরী করা হয়েছে। এবং অন্ধের মত আমরা একটা গোটা জাতি সেইসব মেকি পার্থক্যকে সাদরে গ্রহণ করে আনন্দে ‘একে অন্যের পরিপূরক’ হেডলাইনের তলায় নিশ্চিন্ত দিন যাপন করছি। 

যে ব্যাপারটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় উঠে আসে তর্কে তা হল- মেয়েদের বুদ্ধি ছেলেদের তুলনায় কম। এ ক্ষেত্রে বলে রাখি, বুদ্ধি একটা মানসিক বৈশিষ্ট্য। Cerebral trait. এবং সেরিব্রাল ট্রেট এর কোন লিঙ্গ বিভাজন হয় না। কিছু ‘মানুষ’ এর IQ লেভেল ঘটনা চক্রে আরেকজনের থেকে বেশি বা কম হতেই পারে। এবং এর পেছনেও কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে। সেটা সাইকোলজিস্টরা নিশ্চয়ই তথ্য এবং তত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু সেটা কোনভাবেই gender এর ওপর নির্ভর করতে পারে না। ব্যক্তিগত ভাবে আমার পরিচিত লোকজনের মধ্যে এমন প্রচুর নারীরা রয়েছেন যাদের বুদ্ধি কিংবা জ্ঞানের পরিসর আমারি পরিচিত অনেক পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। তবে এটাও ঘটনা, এদের মধ্যে  অনেকে নিজের বুদ্ধির চর্চা করে না। এটাও অস্বীকার করা যায়না, বেশির ভাগ নারীদের আগ্রহ হচ্ছে এমন সব বিষয়ে যেসব চর্চা করলে বুদ্ধিতে ঠিক শান দেওয়া যায় না। এবং এই পরিণতির জন্য দায়ি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। যার ধারক এবং বাহক পুরুষ–নারী দুই ই। 

আমাদের পারিবারিক, সামাজিক স্থিতি ঠিক এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যেখানে সাধারণত মেয়েদের পৃথিবীটা গড়ে ওঠে দৈহিক সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ইস্যু ভিত্তিক। সে জন্যই তার বিনোদনের উৎস ও পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত। মানে শাড়ি, গয়না, শপিং, টিভি সিরিয়াল। কোনটাই গঠন মূলক নয়। এবং কারো চর্চা যদি এসব বিষয় নিয়ে হয় সেখানে বুদ্ধির চর্চা কি করে হয়! শৈশব থেকে মেয়েদের আলাদা করে রাখা হয়, তার শখ–আহ্লাদ, পড়াশুনো সমস্ত কিছু নির্ধারণ করে দিয়ে। তার কাছে বিনোদনের উপাদান রাখা হয় নির্ধারণ করে, তারপর ধীরে ধীরে তার অভ্যেস গড়ে ওঠে। এর মধ্যেও ব্যতিক্রম ঘটে না, তা নয়। কিন্তু আমি সামাজিক প্রথাগুলির দায়বদ্ধতার কথা বলছি। 

একজন নারীর কাছে বিনোদন হিসেবে বাইক চালানো, পাড়ায় আড্ডা মারা, ক্রিকেট খেলার অপশনই যদি না আসে, বা স্বতস্ফুর্তভাবে না আসে, তবে সে আসলে কি পছন্দ করছে সেটা সে হয়তো নিজেও বুঝতে পারে না। নিজেকে আবিষ্কার করাটাও হয়ে ওঠে না বেশির ভাগের ক্ষেত্রে। পড়াশোনা, চাকরির ক্ষেত্রেও তাই। বেশ একটা অলিখিত নিয়মের মত গৎবাধা শিক্ষা এবং পরবর্তীকালে ‘মেয়েদের উপযোগী’ চাকরি। শিক্ষা, চাকরি বা জীবন ধারণ এর উপায়– শুধু মানুষ নয়, এদেরও আমরা লিঙ্গ বৈষম্যে ভাগ করেছি। আর তারপর ঠোঁট উলটে অবজ্ঞার সুরে বলছি দূর, মেয়েরা এসব পারে নাকি!  

লেখক: অ্যাডভারটাইজিং প্রোফেশোনাল ও লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত