আহা রে, ওর তো বিয়ে হয়নি!
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০১৯, ২১:০৫
আমরা আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে খুবই গর্ব করি। যে গর্ব করে না, তাকে ব্রাত্য করে দিই, সেটাও সগর্বেই। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে (বলা ভালো নিজেদের গড়ে তোলা সংস্কৃতিতে) যে কিছু অলিখিত নিয়ম তৈরী করে রেখেছি, কখনো কি তার যৌক্তিকতা সম্পর্কে সেভাবে ভেবে দেখেছি? বা দেখি? সবাই নয়, অধিকাংশ মানুষের কথাই বলছি। স্বাধীন নাগরিক হয়ত বা আমরা, কিন্তু ব্যক্তিগত পরিসরেই তো পরাধীন আমরা বহু জায়গায়। যে মুহূর্তে ভাবার মতো ক্ষমতা হয়, তখনও কি ভাবতে দেওয়া হয়? নাকি যা চারপাশে চলছে, ঠিক সেভাবেই সেগুলোকেই নিয়ম হিসেবে মেনে নিয়ে এগিয়ে চলাটাই হয়ে ওঠে অলিখিত নিয়ম?
বিশেষ করে আমাদের সামাজিক অবস্থানে বিয়ের ভূমিকা এবং বিয়ের অপরিসীম গুরুত্ব। সারাজীবনে সম্ভবত এর থেকে বেশি গুরুত্ব আর কোনও কিছুকেই দেওয়া হয় না। যে কোন সামাজিক পরিচিতির মূল জায়গা হয়ে দাঁড়ায় একজন ব্যক্তির বৈবাহিক অবস্থান। সামাজিক নিয়মে যার যে সময়ের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা, তার দু’তিনশ দিন পেরিয়ে যাওয়া মাত্রই ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে শুনতে হবে ‘কী হল, ওর তো বিয়ের বয়স হয়ে গেলো’ ‘কী রে বিয়ে করবি না?’ ‘আর কত দেরি করবি? বিয়ের বয়স তো হয়ে গেল’ কেউ যদি মুখ ফস্কে বলে ফেলল, ‘না আমার ইচ্ছে নেই, প্ল্যান নেই’ ব্যাস, অমনি, ‘বুড়ো বয়সে কে দেখবে?’ এইবারে ব্যক্তিটি যদি ঘটনাচক্রে নারী হন, তাহলে তো অবধারিতভাবে ‘এতো পড়াশুনা করে কি হবে, তার পরে আর মানানসই ছেলে পাওয়া যাবে না’ কিংবা স্বগতোক্তিঃ ‘ইস, মেয়েটা দেখতেও ভাল, ফ্যামিলিও ভাল, তবু একটা বিয়ে হচ্ছে না!’।
এই ব্যাপারগুলো যদি আমাদের সামাজিক অবস্থান এবং সংস্কৃতির ধারক কিংবা বাহক হয়, তবে আমি সর্বতোভাবে সেই নিয়মকে লাথি মারি। প্রথমত, একজন ব্যক্তি, তিনি বিয়ে করবেন কী করবেন না, সেটা সম্পূর্ণভাবে তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। দ্বিতীয়ত, শিক্ষিত এবং সুন্দরী হওয়ার সঙ্গে বিয়ে করা বা না করার কোনও সম্পর্ক নেই। দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এখানেই আসলে আমাদের স্বাধীনভাবে ভাবতে না পারার অক্ষমতা লুকিয়ে। বলা ভালো, স্বাধীনভাবে ভাবতে না দেওয়ার ক্ষমতায়নও লুকিয়ে। কোনও ব্যক্তি, তিনি বিয়ে করবেন কী করবেন না এটাই যে একটা নির্বাচনের বিষয় সেই ভাবনার বিকাশ ঘটানোর মত অবকাশ আমরা কাউকে দিই না। বিশেষত আমি নারীদের কথাই বলবো। কারণ এই অলিখিত নিয়মের শিকার হিসেবে আমি নারীদেরই বেশি দেখেছি। জ্ঞান হওয়া মাত্র কেউ যদি এই টোপের মধ্যে ঢুকে পড়ে, সে তো নিজেও জানতে পারে না আদৌ বিয়ে তার কাছে কোনও অপশন কী না। তার কাছে এটা একটা অবশ্যম্ভাবী ঘটনা, যা করতেই হবে। নইলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অব্দি শুরু হয়ে যেতে পারে। আমার পরিচিত বহু নারীরা রয়েছেন, যারা আত্মনির্ভরশীল, বিয়ে করতে চান না মন থেকে। কিন্তু শুধুমাত্র চারপাশের তথাকথিত শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে এই এক কথা শুনতে শুনতে একটা সময়ে তাদের আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকে। অথচ, আত্মবিশ্বাস মানে হচ্ছে নিজের ওপর বিশ্বাস, সেক্ষেত্রে আমাদেরই বানানো একটা নিয়মের পাকে পড়ে একটা সিস্টেম এর ওপরেই নির্ভরশীল হতে হবে তার আত্মবিশ্বাসকে? খুব গ্লানির পরিণতি নয় কি এটা?
আমরা অন্যের স্বাধীন চিন্তাধারাকে প্রাকৃতিক নিয়মে এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারি না, বরং পেছনে টেনে তাকে জোর করে একটা সিস্টেমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে দিই। এবং ভাবি, আমরা তার শুভাকাঙ্ক্ষী। একজন মানুষ, তিনি বৈবাহিক সম্পর্কে যাবেন, নাকি বই-বাহিক সম্পর্কে থাকবেন, লিভ ইন করবেন, নাকি চারজন বন্ধু মিলে কো-লিভিং করবেন, নাকি রবিনসন ক্রুসোর মত একাকী একটা দ্বীপে থাকবেন, সেটা সম্পূর্ণভাবে তার সিদ্ধান্ত। সেখানে তার পরিবার থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশি, কাকা, কাকীমা, কাকার বন্ধু, কাকীমার ছোটবোন, যে কোনও কারোরই কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না- এই শিক্ষা আমরা আর কবে পাবো? একজন মানুষ জন্মায় একটা পরিপূর্ণ জীবন কাটাবে বলে, সেই পরিপূর্ণ জীবন বিয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। ঘটনাচক্রে কেউ বিয়ে করবে, যার ইচ্ছে হবে না সে করবে না। ‘ওর তো বিয়ে হয়নি’ কারোও অক্ষমতা নয়, বরং তাকে করুণার চোখে দেখাটাই আপনার অশিক্ষা এবং অক্ষমতা।
লেখক: অ্যাডভারটিজমেন্ট প্রফেশনাল এবং লেখক