সে যুগ হয়েছে বাসি, যে যুগে নারী দাস ছিলো নাকো পুরুষেরা ছিল দাসী!
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০১৬, ২৩:১৮
কি! শিরোনাম দেখে চমকে যাচ্ছেন? নারী কীভাবে দাস হয় আর পুরুষ কীভাবে দাসী হয়- এইতো? ব্যাকরণ পুস্তক নিয়ে তেড়ে আসার দরকার নেই। আমি ব্যাকরণ নিয়ে কথা বলতে আসিনি। এসেছি সমতার কথা বলতে, মানবতার কথা বলতে। যে সমতার বলে আমাকে লেখক ভিন্ন ‘নারী লেখক’ বা ‘লেখিকা’ এই দুটোর একটিও লেখা হবে না।
আমি বলতে এসেছি সেই সময়ের কথা যখন নারীর শরীরের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতো নারী নিজে। কোনো পুরুষ নয়। সেই সময়ের কথা বলতে গেলে পতিতাবৃত্তির কথা উঠে আসে। এর মধ্যে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত প্রাচীন চীন বা জাপানের গেইশারা, কংকুবাইনরা অথবা বাইজেনটাইন শাসকদের হারেমের বাইজিরা, এমনকি হালের কল গার্লরাও স্থান পাবে না। স্থান পাবে আরও প্রাচীন কিছু জাতিগোষ্ঠী যারা নারীর শরীরকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করতো।
পতিতাবৃত্তির ইতিহাসের সাথে শরীরের মূল্যের ব্যাপারটি জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় পতিতাবৃত্তির কথা লেখা হয়েছে বেশকিছু ক্ল্যাসিকাল টেক্সটে। যেগুলির প্রমাণ পাওয়া যায় মিশরীয়, সুমেরিয় এবং প্রাচীন আরও কিছু জাতিগোষ্ঠীর পবিত্র লিপিতে, বাইবেলের ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্টে।
ধারণা করা হয়- পতিতাবৃত্তি পেশাটি সংগঠিত হতে শুরু করে খ্রিষ্টপূর্ব ছয় শতকে। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে মিশরীয় সভ্যতায় নাগ হামাদি কর্তৃক আবিষ্কৃত আইসিসের প্রতি হেমনের বাণী তারই সাক্ষ্য দেয়। পরবর্তীতে গ্রীক শাসক সেলন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বেশ্যালয় স্থাপন করতে শুরু করেন এবং চামড়ার ব্যবসার ওপর কর ধার্য করেন। এথেনীয় ব্যবসায়ীরা এতে খুবই খুশি হয়, কারণ পতিতাবৃত্তি একসময় নিষিদ্ধ ছিল, এর মাধ্যমে সেটি বৈধতা পায়। কাকে কত কর দিতে হবে সেটিও নির্ণয় করে দেন শাসককূল।
সবচেয়ে সস্তা পতিতাদের বলা হতো ‘পেরনাই’, এরপর ‘পেরিপাটেটিকা’- এরা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর পতিতা। তবে সবচেয়ে এলিট বা অভিজাত শ্রেণীর পতিতাদের বলা হতো ‘হেটারিয়া’। হেটারিয়ারা মূলত ব্যবসায়ী আর সম্রাটদের উপপত্নী হতো, দামী খাবার খেতো, দামী পোশাক ও অলঙ্কার ব্যবহার করতো, বিলাসী ভ্রমণের সফরসঙ্গী হতো, এমনকি রাজনীতির বড় একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো এই পতিতারা। শরীর বিক্রির সাথে ক্ষমতাশালী হওয়ার ব্যাপারটি সত্যিই অবাক করার মতন ছিল।
গ্রীক ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক হেরাডোটাসের মতে পতিতাবৃত্তি সম্পর্কিত চমৎকার কিছু ক্লাসিক্যাল টেক্সট পাওয়া যায়। হেরাডোটাস প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার রাজধানী ব্যাবিলনিয়া সম্পর্কে লিখেছেন,
এখানে এক বিচিত্র প্রথা রয়েছে যা সুমেরীয় প্রতিটি নারী মেনে চলে। আর তা হচ্ছে- তারা দেবী ইশাতারের মন্দিরে যায় এবং অচেনা কোনো মানুষকে দেহদান করে। এই দেহদান ব্যাপারটি সুমেরীয়দের কাছে আতিথিয়তার সর্বোচ্চ প্রতীক এবং প্রতীকী মূল্য!
সেসময় গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছিল দেবী ইশাতারের প্রভাব। পরবর্তীতে সিসিলি, ভূমধ্যসাগর, সার্ডিনিয়া এবং রোমান সাম্রাজ্যের সময় ইশাতারের মতন আরেক দেবীর চর্চা হতো, যার নাম- ভাস্তা। কুমারীত্বের আত্মসমর্পণ এই দেবীর উপাসনায় সবচেয়ে বড় প্রার্থনার জায়গা দখল করে নেয়। এদের বলা হতো পবিত্র কুমারীত্ব বিসর্জনকারী। এরা যৌনতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো এবং তাদের শরীর বিবেচিত হতো সম্মানের নিদর্শন হিসেবে। এরা মন্দিরে যৌন উদ্দীপক স্তোত্র গাইত এবং রাজা ও তরুণদের যৌনতার পথে পবিত্রতার আহ্বান জানাতো।
কেউ জানেনা পবিত্র পতিতাবৃত্তি হঠাৎ কেন অদৃশ্য হয়ে গেলো। কেননা এর বয়স ছিল মাত্র দুই শতক প্রায়। ধারণা করা হয় যৌন অজানা কোনো রোগ বা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কারণেই পবিত্র পতিতাবৃত্তির বিলুপ্তির কারণ। অনেক ঐতিহাসিক ধর্মের প্রভাবের কথাও বিলুপ্তির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন, কেননা সামাজিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মেরও সংস্কার ঘটে থাকে। তবে আইসল্যান্ডের উপকথা এডা’য় পবিত্র পতিতাবৃত্তির আভাস পাওয়া যায়। আর প্রাচীন প্যাগানরা যৌনতাকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। প্যাগানদের প্রাচীন পবিত্র নগ্ন নৃত্যের কথা ইতিহাস বিদিত। প্যাগানরা ভেনাসকে রীতিমতো দেবীর মর্যাদা দিতো।
পতিতাবৃত্তির প্রাচীন ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করার পর একালে ঠিক কতোটা আধুনিক আমরা হয়েছি তা প্রশ্নসাপেক্ষ। নারীর দাস মনোবৃত্তির (slave mentality) কথা বেগম রোকেয়া সহ অনেক লেখক লিখেছেন। লিখেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। যে রবীন্দ্রনাথ এক সময় ভাবতেন, প্রকৃতিই নারীকে ‘বিশেষ কার্য্যভার ও তদনুরূপ প্রবৃত্তি দিয়া’ গৃহবন্দী করেছে, সে ধারণা নিজেই বাতিল করে ‘নারী’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আজ পৃথিবীর সর্বত্রই মেয়েরা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্বের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন এই বৃহৎ সংসারের দায়িত্ব তাদের স্বীকার করতেই হবে…ঘরের মেয়েরা প্রতিদিন বিশ্বের মেয়ে হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই উপলক্ষে মানুষের সৃষ্টিশীল চিত্তে এই-যে নূতন চিত্তের যোগ, সভ্যতায় এ আর-একটি তেজ এনে দিলে’।
হয়তো, তাঁর শেষ বয়সে লেডি রাণু, কিংবা ওকাম্পোর মতো মেধাবী নারীরা, আর নিখিলবঙ্গ-মহিলা কর্মীদের উদ্দীপনায় ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, রূপান্তরিত হয়েছিলেন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর উৎসাহে, আন্না তড়গড়ের প্রেমেও।
কাজী নজরুল ইসলাম যেমন সমতার গান গেয়েছেন তেমন করেই বলা যায়:
অথবা পাপ যে, শয়তান যে
নর নহে নারী নহে ক্লীব সে,
তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
তাই নারীকে ভালোবাসতে হলে তার শরীরকে নয় ব্যক্তিত্বকে ভালবাসতে হয়। নিজেকে ছোটো করতে হয় না, নত করতে হয়। প্রেম যেখানে গভীর নত হওয়া সেখানে গৌরবের। পুরুষ নারীকে সেভাবে বলতে শিখুক,
‘হে ঐশ্বর্যবান!
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান!'
পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, পারিবারিক অত্যাচার, সামাজিক অবস্থান, রাজনীতি, অর্থনৈতিক অবস্থান ইত্যাদি নারীর যোনীতে লাগিয়েছে তালা। কুমারীত্ব, সতীত্ব নামের শব্দগুলিকে নারীর গুণের পর্যায়ে নিয়ে গেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে নারীকে করেছে পণ্য। হিজাব অথবা বিকিনি যাই হোক, কোনো পোশাকই নারীর যৌন স্বাধীনতা দেওয়ার ক্ষমতা রাখেনা। যেটি রাখে তা হচ্ছে সচেতনতা।
সতীত্ব কোনো গুণ নয়, যোগ্যতা নয়। যোগ্যতা থাকে মেধা, মননে আর সৃজনে। যোগ্যতা থাকে স্বাধীনতা আদায়ের লীলায়। নারীর যৌনজীবন নারীর ব্যক্তিগত, পুরুষের হস্তগত কিছু নয়!
তথ্যসূত্র:
১। সেন্সিবল সেন্সুয়ালিটি- সরোজিনী সাহু
২। নারী- হুমায়ূন আজাদ
৩। Patterns of Sex and Love: A Study of the French Woman and Her Morals Hardcover – 1961
by French Institute of Public Opinion
৪। A brief history of sex and sexuality in Ancient Greece- written by Paul Chrystal
৫। Evolution of SEX - History Documentary - YouTube.com
৬। A brief cultural history of sex - The Independent.co.UK(issue Sep22,2008)
৭। The Origins of Sex: A History of the First Sexual Revolution (public library) by Oxford University historian Faramerz Dabhoiwala
৮। Sex and History is jointly directed by Professors Kate Fisher and Rebecca Langlands and is a Sexual Knowledge unit project, University of Exeter
৯। Documentary Sex In The Ancient World BBC Documentary
১০। National Geographic - Sex in the Stone age - Video Dailymotion
১১। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে- অভিজিৎ রায়
১২। রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা- সমীর সেনগুপ্ত
লেখক: তরুণ লেখক ও সাহিত্যিক