নারীপন্থী টুইটের অন্তরালে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব?

প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ২৩:৪৯

দিয়া চক্রবর্তী

সমস্ত হিসেবনিকেশ উল্টে পাল্টে দেয়া মার্কিন প্রেসিডেনশাল নির্বাচনকে ঘিরে আলোচনা পর্যালোচনার অনেক কিছুই রয়েছে। এর মধ্যে একটি বিষয় হলো এই নির্বাচনে টুইটারের মাধ্যমে দু'পক্ষের প্রচারণা।

ট্রাম্প এবং ক্লিনটনের নিজের এবং তাঁদের সমর্থকদের করা টুইট প্রচারণার পুরো সময়টা জুড়েই সংবাদমাধ্যমে ঠাঁই করে নিয়েছে। তেমন একটি টুইট নিয়েই আজকে লিখতে বসা।

মাইকেল মোর, বিখ্যাত তথ্য চিত্রনির্মাতা, হিলারি ক্লিনটনের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। মিঃ মোর একজন সমাজ সচেতন, প্রগতিশীল মানুষ বলেই পরিচিত। কিন্তু তাঁরই একটি টুইট অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীর একটি নিদর্শন হয়ে রইল।

প্রায় চার হাজারবার রিটুইট হওয়া এবং সাড়ে আট হাজার লাইক পাওয়া টুইটটি ব্যাপক সাড়া জাগালো ঠিকই কিন্তু মিঃ মোর যেমন চেয়েছিলেন ঠিক তেমনিভাবে নয়।

পুরুষতন্ত্রের শেকড় এমনই গভীর যে অপ্রত্যাশিতভাবে যে কোন পরিস্থিতিতেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। এমনকি সেটি আসতে পারে একজন সদিচ্ছা সম্পন্ন সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রবক্তার কাছ থেকেও।


মাইকেল মোর-এর টুইটটি পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন

মিঃ মোর তার টুইটে দাবি করেছেন পুরুষ জাতি যে সমস্ত নৈতিক ব্যর্থতার জন্য দায়ী - আণবিক বোমা উদ্ভাবন, পরিবেশ দূষণ, গণহত্যা, ইত্যাদি - নারীদের ক্ষেত্রে সেই স্খলনগুলোর কোন নজির নেই ইতিহাসে। এই বক্তব্যের মধ্যে একটি বেশ বড়সড় সমস্যা নিহিত আছে।

ইতিহাস যে সাধারণত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেই রচিত এই বক্তব্যে সেই সত্যটি চাপা পড়ে গেছে। পক্ষান্তরে তাঁর টুইট বিজ্ঞান ও রাজনীতিতে নারীর অবদান যে আমাদের একপেশে জগতে সেভাবে স্বীকৃতি পায়নি সেই সত্যটি এড়িয়ে গেছে।

আণবিক শক্তির গবেষণা - যেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আণবিক বোমার সৃষ্টি - তাতে নারী গবেষকদের অবদান প্রায় উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। আরো জানতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পুরুষ রক্ষীদের পাশাপাশি নারী রক্ষীদেরও দৃষ্টান্ত রয়েছে।

জার্মান বন্দী শিবিরে নারী রক্ষীদের সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

একটুখানি সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই পৃথিবীর ইতিহাসের অংশ নারী পুরুষ উভয়েই, তা সে ইতিহাস শান্তিরই হোক, কি হিংসার। আমাদের পক্ষপাতদুষ্ট মূলধারার ইতিহাসে নারী তবু অদৃশ্যই থেকে যায়।

আশার কথা এই যে মিঃ মোরের টুইটটির দুর্বলতা প্রমাণ করে মুহূর্তেই রাশি রাশি টুইট পোস্ট করা হয়েছে। ইন্টারনেটের শক্তিটা এখানেই, এখানে কোন কিছুই প্রশ্ন বা নিরীক্ষার বাইরে নয়।

মিঃ মোর বোধ করি নিজের অজান্তেই পুরুষতন্ত্রের গভীরে প্রোথিত সেই পুরনো ফাঁদে পা রেখে ফেলেছিলেন যা একটি অলীক ধারণায় বিশ্বাস করে যে নারী কোন না কোনভাবে পুরুষের থেকে ভিন্ন, তাই তারা পুরুষের মত নৈতিক বা বিচারবোধের ব্যর্থতার কাছে নতি স্বীকার করে না।

আপাতদৃষ্টিতে উদার, নিদেনপক্ষে নিরীহ মনে হলেও এই ধারণাটি শুধু যে অসত্য তাই নয়, এটি অত্যন্ত বিপজ্জনকও বটে যা নারী এবং পুরুষের মধ্যে একটি কৃত্রিম বিভেদ তৈরি করে দু'পক্ষকেই কিছু নির্দিষ্ট ভূমিকার মধ্যে বেঁধে রাখতে চায়।

এর ব্যতিক্রম ঘটলেই সমাজ বেঁকে বসে এবং যে নারী-পুরুষ এই গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে আসতে চান তাদের পথ সাধারণত খুব একটা সহজ হয় না, কোন কোন ক্ষেত্রে সম্ভবই হয় না।

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ এবং বর্ণাঢ্য আন্দোলন কিন্তু এই সত্যটিই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে যে নারী ও পুরুষ সর্বতোভাবে সমান, উভয়েই মানুষ এবং তাই উভয়ই মানব জাতির দোষগুণ, নৈতিক উত্তরণ এবং স্খলনের সমান ভাগীদার।

নারীকে তার প্রাপ্য কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করা অথবা তাকে যেকোনো দুষ্কৃতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া একই মুদ্রার এ'পিঠ আর ও'পিঠ। সেই মুদ্রাটির নাম পুরুষতন্ত্র।

লেখক: রাজনৈতিক ভাষ্যকার, লন্ডন
প্রথম প্রকাশ: বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত