বিভক্ত লিবিয়ায় ঐক্যেই সমাধান

প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২০, ১৪:৪৫

এস.এম. রাফিয়া আক্তার
এস.এম. রাফিয়া আক্তার

সম্প্রতি লিবিয়ার মিজদা শহরে হাফতার বাহিনীর হাতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছে। মাত্র এক দশক আগেও লিবিয়া ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ গৃহযুদ্ধ চলার কারণে দেশটির অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো আজ ধ্বংসের দোরগোড়ায়।

এমন পরিস্থিতিতে প্রতিবছর কাজের সন্ধানে এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ থেকেই তরুণরা ইউরোপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দেশটিতে পাড়ি জমায়। যুদ্ধ বিপর্যস্ত তেল নির্ভর অর্থনীতির এই দেশে মানবপাচারের রমরমা ব্যবসা চলে আসছে। কেননা এটি ইউরোপ পৌঁছার পথ হিসেবে ব্যবহার হয়। লিবিয়ায় চলমান অরাজক পরিস্থিতির জন্য অনেক বিশ্লেষক একে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ অথবা ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু আফ্রিকার একসময়ের সবচেয়ে সফল দেশটির এমন করুণ পরিণতি হলো কীভাবে?

তিউনিশিয়ায় শুরু হওয়া আরব বসন্তের ঢেউ প্রতিবেশি দেশ লিবিয়ায় আছড়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৪২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা 'স্বৈরশাসক' কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লিবিয়ার হাজারো মানুষ বিক্ষোভ শুরু করে। বেনগাজীতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ খুব দ্রুতই দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং রাজধানী ত্রিপোলী দখলের মাধ্যমে শেষ হয়। ন্যাটো বাহিনীর সহায়তায় কর্নেল গাদ্দাফীকে করুণভাবে হত্যা করার পর বিক্ষোভকারীরা ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এনটিসি)কে ক্ষমতায় বসায়। 

এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো, বিক্ষোভ চলাকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে গাদ্দাফি রেজিমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের আরও খানিকটা উস্কে দেয়। পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পর অবস্থা বেগতিক হলে আমেরিকান পার্লামেন্ট লিবিয়ায় সীমিত পরিসরে হস্তক্ষেপ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ইতিহাস বলে বিদেশি হস্তক্ষেপের ফলাফল কখনোই সুখকর হয় না। বিশ্ব ইরাক এবং আফগানিস্তানের করুণ পরিণতি দেখেছে এবং দেখছে। লিবিয়ায় বিদেশি হস্তক্ষেপ বৈধ করতেই দেশটিতে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকগণ শুধুমাত্র বিক্ষোভকারীদের একপাক্ষিক মতামত তুলে ধরে বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চায় যে লিবিয়ার জনগণকে স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির হাত থেকে বাঁচাতে বিদেশি হস্তক্ষেপের কোন বিকল্প নেই।

বিশ্ববাসী আশা করেছিল যে লিবিয়া আরেকটি 'নতুন ইরাক' অথবা 'নতুন আফগানিস্তান' হবে না। স্বৈরাচারের অবসান  ঘটিয়ে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে লিবিয়া আরও উন্নতি সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। গাদ্দাফির সুদীর্ঘ শাসনামালে লিবিয়াই ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র, কিন্তু গাদ্দাফি নিহত হবার পর খুব দ্রুতই লিবিয়ার চিত্রপট পাল্টে যায়। প্রকৃতপক্ষে ‘গণতন্ত্র’ খুব অনির্দিষ্ট একটি শব্দ। লিবিয়ায় তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবার পর যারা একসাথে হয়ে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছিল, তারাই আবার নিজেদের মধ্যে অরাজকতা, হানাহানি শুরু করে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ‘অপারেশন ডিগনিটি’ পরিচালনার মাধ্যমে খলিফা হাফতার (গাদ্দাফির দীর্ঘ সময়ের বন্ধু যে তাকে ক্ষমতায় আরোহণ করতে প্রতক্ষভাবে সহায়তা করেছিলেন। পরবর্তীতে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় আমেরিকায় পাড়ি জমান এবং ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় লিবিয়ায় ফিরে এসে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন) আলোচনায় আসেন। সেই সময় থেকে লিবিয়ায় দুটো সরকার পরিচালিত হয়ে আসছে; একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত ও জাতিসংঘ সমর্থিত  রাজধানী ত্রিপলি কেন্দ্রিক ‘গভঃমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকোর্ড’ (জিএনএ) এবং অপরটি খলিফা হাফতার নিয়ন্ত্রিত তব্রুক কেন্দ্রিক ‘হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ’ (এইচওআর)। এইচওআরকে নিয়ন্ত্রণ করলেও সরকার প্রধান হবার লক্ষ্য খলিফা হাফতারের কখনই ছিল না। বরং সমরনায়ক হয়ে লিবিয়ার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জায়গা এবং তেলক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য।

আরব বসন্তের সময় শুরু হওয়া তথাকথিত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ থেকে শুরু হয় লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ। যার বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ, সেই গাদ্দাফিকে উৎখাত করার পরও গৃহযুদ্ধ থামেনি। বরং গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সৃষ্ট পাওয়ার ভ্যাকাম তথা ক্ষমতা শুন্যতার জন্য বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী দেশটিতে তৎপরতা চালাতে শুরু করে। জাতিসংঘ সমর্থিত জিএনএ ও হাফতার সমর্থিত এইচওআর উভয়পক্ষই বিভিন্ন সময়ে এসব জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করে আসছে। দেশটির অরাজকতার সুযোগ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেখানে প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছে। যার ফলে লিবিয়া প্রক্সি যুদ্ধের অনন্য ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

ভূমধ্যসাগরকে কেন্দ্র করে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এজন্যই ভুমধ্যসাগরের আশেপাশের দেশগুলোতে প্রচুর জীবাশ্ম জ্বালানীর মজুদ খুঁজে পাওয়া যায়। আর বর্তমান সভ্যতার চালিকা শক্তিই হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানী। এসব জ্বালানী ব্যবহার করেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যার মাধ্যমে পৃথিবীর শিল্পকারখানাগুলো চলে। মূলত লিবিয়ার এই তেলের খনিগুলোর জন্য বেশকিছু শিল্পসমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ায় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে বরাবরই নাক গলিয়ে আসছে। এরমধ্যে রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মিশর ও ফ্রান্স হাফতারের পক্ষপাতিত্ব করেছে এবং জাতিসংঘ, ইতালি, কাতার ও তুরস্ক জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের পক্ষপাতিত্ব করছে। সিরিয়ার মতো লিবিয়াতেও আমেরিকার ভূমিকা বিভ্রান্তিকর। তবে এই ক্ষেত্রে ফ্রান্সের অবস্থান খুব বিস্ময়জনক। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশটি মৌখিকভাবে ত্রিপোলি কেন্দ্রিক সরকারকে সমর্থন জানালেও নিরাপত্তা পরিষদে যখন হাফতারের বিরুদ্ধে রেজোলিউশন প্রস্তাবিত হয় তখন ভেটো প্রদানের মাধ্যমে তা বাতিল করে দেয়। কেন করে সেটার কারণ মোটামোটি পরিষ্কার। হাফতার বাহিনী নিয়ন্ত্রিত তেলের খনি থেকে ব্যারেল ব্যারেল তেল প্রতিদিনই প্যারিসে পৌঁছে যায়। রাশিয়াও তেলের বদলে অস্ত্র পাঠাচ্ছে এই বাহিনীকে। আদর্শগত পার্থক্য থাকা স্বত্বেও পুঁজিবাদী দেশ আমেরিকা তেলের লোভে হাফতার বাহিনীকে অস্ত্র পাঠায় এবং ইউএই, সৌদি, ফ্রান্স, রাশিয়া, মিশর মিলে হাফতারের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ত্রিপোলি কেন্দ্রিক সরকারের বিপক্ষে প্রক্সি যুদ্ধ চালাতে থাকে।

শুরুতে হাফতার শক্তিশালী আক্রমণের মাধ্যমে লিবিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করতে থাকলেও গত কয়েকদিনে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার বাহিনী সেসব জায়গা পূর্ণদখল করতে সক্ষম হচ্ছে। ইতোমধ্যে আরব লীগও হাফতার সমর্থিত এইচওআর-এর উপর থেকে সমর্থন সরিয়ে নিয়ে জাতিসংঘ সমর্থিত জিএনএ-কে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে হাফতারের সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে কি না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে যে ত্রিপোলি কেন্দ্রিক সরকার কর্তৃক হাফতার বাহিনী পুরোপুরি উৎখাত হলে হয়তো লিবিয়ায় শান্তি ফিরে আসবে। লিবিয়ার জনগণ আর কখনই সামরিক শাসনে ফিরে যেতে চায় না। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়, গাদ্দাফির মতো হাফতারকে উৎখাত করলেই কি লিবিয়ার যুদ্ধ থামবে? বহু আকাঙ্ক্ষিত ‘গণতন্ত্র’ কি তখন লিবিয়াবাসীর হাতে পুরপুরি ধরা দেবে? নাকি ইরাক, আফগানিস্তানের মতো আরো কয়েক দশক ধরে এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে? একসময়কার আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি পুনঃর্নির্মাণের দায়িত্ব নেবে কে? 

জ্যামিতিক আকারে ভাগ করা আফ্রিকার অন্য দেশগুলোর মতো  লিবিয়াতেও বহুসংখ্যক নৃগোষ্ঠী বাস করে। তাদের মধ্যে সবসময়ই সংঘাত লেগে থাকে। কিন্তু গাদ্দাফি বিরোধী আন্দোলনের সময় আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ডেরা গাদ্দাফীকে ‘সাধারণ শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে  সবগুলো গোষ্ঠীকে একত্রিত করতে পেরেছিল। তাই গাদ্দাফিকে হত্যার পর গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সম্পর্কের ফাটল আবারও প্রগাঢ় হয়; যার ফলশ্রুতিতে লিবিয়াবাসীকে নয় বছর যাবত সংঘটিত ভয়াবহ এক গৃহযুদ্ধের সাক্ষী হতে হয়েছে। বিভিন্ন সুযোগসন্ধানী রাষ্ট্র এসব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ‘আমরা বনাম তারা’ নীতিতে বিভাজন তৈরি করে নিজেদের ফায়দা উসুল করতে চাইছে। তাই লিবিয়ার সমস্যা সমাধান করতে চাইলে এগিয়ে আসতে হবে লিবিয়াবাসীকেই। বিশ্বের যেসব দেশ নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য লিবিয়ায় ঘৃণ্য খেলায় মেতেছে, তাদেরও এখন লোভের উপর লাগাম টেনে ধরতে হবে। তা নাহলে দেশটিতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকা জঙ্গিবাদ বিশ্ববাসীকে আরেকটি নয় এগারোর সাক্ষী হতে বাধ্য করবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম প্রকাশ: সমকাল, ২৩ জুন ২০২০

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত