সংসার ও মাতৃত্ব, সমাজ ও রাজনীতি দুটিই খুব ভালোভাবে সামলেছিলেন বঙ্গমাতা

প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২০, ১২:৩৮

তুরিন আফরোজ

শৈশবের খেলার সাথী খোকা ভাই, খোকা ভাই থেকে মুজিব, মুজিব থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা এবং সবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আততায়ীর হাতে স্বামীর সাথে সহমরণ এর সবকিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন বঙ্গমাতা। কিন্তু আজকে বঙ্গমাতার জন্মদিনের শুভক্ষণে আমি তাঁকে ব্যাক্তি ফজিলাতুন্নেছা ওরফে ‘রেণু’ হিসেবেই মূল্যায়ন করতে চাই। এই জন্মদিনটি শুধু তাঁর হয়েই থাকুক!

রেণু মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা-মা হারিয়ে পৃথিবীতে একা হয়ে যায়। একটা পাঁচ বছর বয়সী পিতৃ-মাতৃহীন শিশুর উপর কী মানসিক একাকীত্ব ভর করে তা শুধু সেই বোঝে, যার একই রকম অভিজ্ঞতা হয়। জীবন যুদ্ধ তো তাঁর সেদিন থেকেই শুরু। বড় হয়েছেন দাদার বাড়িতে। আদরের কমতি হয়নি সেখানে। তবুও মা-বাবা হারানোর কষ্ট নিয়েই তাঁকে পথ চলতে হয়েছে সেই অল্প বয়স থেকেই। বাবার কোমল স্পর্শ আর মায়ের বুকের উষ্ণতা বুঝতে পারার আগেই এই পৃথিবীতে একা হয়ে পড়ে রেণু। পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া তাঁর সহজাত অভ্যাসে পরিণত হয়ে ওঠে। আর পরকে আপন করেই রেণু জীবনের পথ চলাকে মেনে নেয়।  রেণুর বিয়ে হয় খুব অল্প বয়সে। যদিও স্বামীটি অপরিচিত কেউ ছিল না, শিশুকালের খেলার সাথী ‘খোকা ভাই’। এক সাথেই বড় হয়ে ওঠা। তাই কাছে থেকেই স্বামীকে বোঝার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন হয়তো অনেক ছোট বেলা থেকেই। সংসার শুরু হয় দশ বছর বয়সে। তখনকার দিনে অমনটি-ই হতো। কিন্তু রাজনীতি করা স্বামীকে ভালোবেসে বুঝতে পারা দশ বছরের বালিকা-বধূর জন্য মোটেও সহজ কথা নয়।

কিন্তু রেণু হয়ে ওঠেন রাজনীতিবিদ স্বামীর যোগ্য সহধর্মিনী। রেণুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করা হয়ে ওঠেনি তেমন করে। কিন্তু নিজেকে স্বশিক্ষিত করে তোলার প্রয়াসে কমতি ছিল না তাঁর। রেণুর সংসার জীবন যখন থেকে শুরু হয়েছে তখন থেকেই তাঁর রাজনীতিবিদ স্বামী বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরে থাকতেন। স্বামী বাইরে থাকাকালীন সময়ে রেণু অবসর সময়ে বিভিন্ন রকমের বই পড়তেন, গান শুনতেন। আর যখন রাজনীতিবিদ স্বামী বাড়ি আসতেন, তখন তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন বইয়ের বিষয়বস্তু ও কাহিনি নিয়ে আলোচনা করতেন। সেই আলোচনাগুলো কখনো কখনো রাজনৈতিক আলোচনায় রূপান্তরিত হতো। রাজনীতিবিদ স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী করে রেণু নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন বটে।

কদিকে সংসার ও মাতৃত্ব, অন্যদিকে সমাজ ও রাজনীতি দুটোই সামলিয়েছেন রেণু। রেণুর প্রথম সন্তান তাঁর মা সম্পর্কে বলেছেন, ‘মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ নারী। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এই রমণী অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারতেন। জীবনে তাঁর কোনো চাহিদা ছিল না। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল খুবই প্রখর। তিনি অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। ৬ দফা আন্দোলনের সময় তিনি নিজের অলংকার বিক্রি করে সংগঠনের জন্য আর্থিক চাহিদা মিটিয়েছেন। স্বামী প্রায় ১২ বছর জেলে কাটিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনে। বন্দিকালে তিনি সংসারের ভার বহন করেছেন, ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন, শত শত কর্মীদের খবরাখবর রেখেছেন এবং দুস্থ কর্মীদের সহায়তা করেছেন। একজন মায়ের সকল দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ প্রকাশ পেত তাঁর মাঝে’।

রেণুর রাজনীতিবিদ স্বামী দেশের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিলেন একমাত্র তাঁরই জন্য। রাজনীতিবিদ স্বামীকে কখনো সংসারের জন্য ভাবার সুযোগ দেননি রেণু। রেণুর ছোট কন্যা তাঁর বাবার প্রতি মায়ের ভালোবাসা ও যত্নের কথা বর্ণনা করেন এভাবে- ‘যখন গ্যাস ছিল না গরমের ভেতর দিয়ে কাঠের চুলায় ফুঁ দিয়ে ঘর্মাক্ত কলেবর হতে মাকে দেখেছি, তবুও বাবার রান্না তিনি বরাবরই নিজ হাতে করতেন।’ এই যে রেণু, একা একা পথ চলতে চলতে কোটি বাঙালির হৃদয়ে ভালোবাসার জায়গা করে নিলেন তা কি শুধু শুধুই? সংসার ধর্ম পালন করেছেন শক্ত হাতে, সন্তান-সন্ততি লালন-পালন করেছেন অকৃত্রিম মমত্ববোধে, একই সাথে রাজনীতিবিদ স্বামীর পাশে থেকেছেন শক্ত ভিত হিসেবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ লেখার মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল তাঁর জীবনসঙ্গী রেণু। জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ স্বামী অসংখ্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁর স্ত্রী রেণুর সাথে পরামর্শ করে। রেণু সারা জীবন অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে স্বামীকে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে গেছেন।

রেণু স্বামীকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন স্বামীর রাজনৈতিক স্বপ্ন-সাধনাকে। ধারণ করতেন স্বামীর সোনার বাংলার চেতনাকে। আর তাই, ৬ দফা আন্দোলনের সময়ের দৃঢ়তা, লাহোর গোলটেবিল বৈঠকে প্যারোলে অংশগ্রহণ না করার পরামর্শ, ভুট্টোর সাথে ছয় দফা নিয়ে সমঝোতা না করার পরামর্শ, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যে সঠিক দিক নির্দেশনা আর যে দূরদর্শিতা রেণু দেখিয়েছিলেন তা ইতিহাসে বিরল। আজ রেণুর জন্মদিনে একটি উপলব্ধি আমার চেতনায় বার বার ঘুরে ঘুরে আসছে। রেণু ‘বঙ্গমাতা’ ছিলেন তো বটেই. কিন্তু তার চেয়ে বেশি ছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু-প্রেয়সী’, আপন মহিমায় উদ্ভাসিত এক নারী। ঘোর বিপদের অমানিশায় এই জনমে যেমন অটল থেকেছেন রাজনীতিবিদ স্বামীর পাশে, ঠিক তেমন করেই পাড়ি দিয়েছেন পরজনমের পথে, সহমরণে। বিধাতা তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে চাননি তাঁর আজীবনের ভালোবাসার মানুষটি থেকে নতুন কোনো গ্রহে, নতুন কোনো আলোকে। নতুন কোনো পৃথিবীতে তাঁরা একসাথেই বেঁচে আছেন, থাকবেন। শুভ হোক জন্মতিথি, হে, ‘বঙ্গবন্ধু-প্রেয়সী’।

লেখক: আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষক
প্রথম প্রকাশ: আমাদের সময়, ০৮ আগস্ট, ২০২০

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত