নারীবাদের ট্যাবু ভাঙা বই- দাস জীবনের মালিক নারী?
প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৬:৫৭
যে নারীবাদ নারীর জীবনকে ঘিরে সমাজের তৈরি করা সব ট্যাবুর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে, সেই নারীবাদকে ঘিরেই কখনো তৈরি হয়ে যায় কিছু ট্যাবু, কিছু নির্দিষ্ট নীতিমালা। কিন্তু নারীবাদকে যিনি বলেন 'নারীবাদ মানে প্রশ্ন তোলা, অবিরাম প্রশ্ন তোলা ও চ্যালেঞ্জ করা' সেই সাদিয়া নাসরিন এর এবারের বইমেলায় প্রকাশিত বই 'দাস জীবনের মালিক নারী?' তাই আওয়াজ তুলেছে নারীর বিরুদ্ধে সামাজিক সকল প্রথার শৃঙ্খল এর পাশাপাশি নারীবাদকে ঘিরে সব ট্যাবুর বিরুদ্ধেও।
বইটির সবচেয়ে প্রশংসনীয় ব্যাপার আমার কাছে মনে হয়েছে এর মধ্যে উঠে আসা কথাগুলো একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরে আবদ্ধ থাকেনি, বরং আঘাত করেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বানানো অসংখ্য দেয়ালে। একজন প্রকৃত নারীবাদীই যে হয়ে উঠতে পারেন একজন প্রকৃত সচেতন মানুষ তারও সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলে যখন লেখক নারীকে নারীত্বে বন্দি করার যে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাথে সাথে ধর্মান্ধ সমাজ, ধর্ষণ, হত্যা, সাহিত্যে লিঙ্গ বৈষম্য, শিশুদের নিরাপদ শৈশব, নারীবাদের প্রতি পুরুষ এমনকি নারীদের নেতিবাচক মনোভাব, খেলার মাঠে নারী, বিবাহ প্রথা, চলচ্চিত্রে নারীর অবস্থান সবকিছু নিয়েই সচেতন বক্তব্য দেন। এসব বক্তব্যে কখনো যেমন ভাষা চরম ক্ষুরধার, তেমনি কখনো চিন্তাশীল, যুক্তির আঘাতে পরিপূর্ণ।
বইটির নাম শুনে অনেকেরই মনে হতে পারে, নারীবাদী লেখক এর বই, নিশ্চয়ই নারীবাদ আর পুরুষ বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। কিন্তু লেখকের ভাষ্যেই বইটিতে উঠে এসেছে নারীবাদের অবস্থান, প্রয়োজনীয়তা ও এ নিয়ে ভুল ব্যাখ্যার অবসান। উঠে এসেছে শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের কথাই নয়, বরং সেইসব নারীর কথাও যারা পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের মনভুলানো কিছু সুবিধা পেয়ে ক্ষমতাবান হয়েও আদতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একজন প্রতিনিধির মতোই আচরণ করেন। প্রশ্ন উঠেছে সেইসব নারীদের উপরে যারা নিজেদের অধিকার ও কর্তব্যের কথা ভুলে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়মের মধ্যে বেড়ে উঠা কিছু সুযোগ সুবিধা পেয়েই নিজেকে ধন্য ও সার্থক মনে করেন। নারীর অধিকারের পক্ষে কাজ করেও নিজেকে নারীবাদী বলতে কুণ্ঠিত হন যারা তাদের জন্যও উঠে এসেছে নারীবাদের ইতিহাস ও ব্যাখ্যা। নিজের পুত্রের কাছে চিঠি লেখার মাধ্যমে উঠে এসেছে কিভাবে লিঙ্গ বৈষম্যের রাজনীতি শুধু নারী কিংবা কন্যাদেরই নয়, বরং আমাদের পুরুষ তথা পুত্রদের জীবনের ক্ষতিসাধন করে। উঠে এসেছে সমাজের আপাত দৃষ্টিতে ভালো, চরিত্রবান এমনকি নারীর পক্ষে লড়াই করা অনেক পুরুষও কিভাবে গভীরে পুরুষতান্ত্রিকতাকে লালন করেন তার কথা।
আবার লেখকই প্রশংসা করেছেন সেইসব পুরুষের যারা প্রতিনিয়ত বিশ্বব্যাপী নারীদের এই সংগ্রামে সাহস ও প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন। মাতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার না করেই, 'মাতৃত্বের স্বাদ কেবল নারীই পায়', কিংবা 'মাতৃত্ব শুধু নারীরই কর্তব্য' এই চিরাচরিত ধারণাকেও প্রশ্ন করে লেখক তুলে ধরেছেন কিভাবে একজন পুরুষও হয়ে উঠতে পারে মা, পেতে পারে মাতৃত্বের স্বাদ। নিজের বাবার জীবনের গল্প দিয়ে বুঝিয়েছেন কিভাবে একজন পুরুষও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে একজন নারীর জীবনে প্রাণ এনে দিতে পারেন। তাই এই লেখাগুলো সমাজের বেশিরভাগ মানুষ নারীবাদ বলতে কিংবা নারীবাদী লেখক বলতে যা বুঝেন তার প্রতিফলন নয়, বরং একজন প্রকৃত মানুষ যিনি নারীবাদের আসল আদর্শ ও চেতনাকে ধারণ করে মানুষের মুক্তির সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক হন তার কথাই।
পরিশেষে বলা যায়, 'দাস জীবনের মালিক নারী?' বইটি শুধু নারীবাদের পক্ষের নারী পুরুষ নয়, বরং নারীবাদকে যারা অগ্রাহ্য করেন কিংবা অপ্রয়োজনীয় বলে অভিহিত করেন তাদের সকলের জন্যই অবশ্যপাঠ্য। কারণ এই বইটিই আপনাকে শেখাবে নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করতে; শেখাবে এই সমাজ ও সামাজিক প্রথাকে প্রশ্ন করতে; দীর্ঘদিন ধরে যে ভ্রান্তির আড়ালে থেকে কোন নারী নিজেকে স্বাধীন ও সুখী ভেবে আসছে, কিংবা পরিবারের পুরুষ মানুষটিকে আদর্শ মানুষ ভেবে আসছে, সেই ভ্রান্তির পর্দা সরিয়ে নিজেকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে লড়াই করতে শেখাবে।