পার্থক্য শুধু শিরদাঁড়ায়!
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০১৬, ২২:০৬
মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভ উদ্বোধন হয়েছে। নিঃসন্দেহে খুবই দারুণ উদ্যোগ! ওদিকে সাঁওতালরা সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে তারা জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার হয়ে যাবে, উত্তরের শীতে থিরথির করে কাঁপবে, বাচ্চাদের মুখে খাবার না তুলে দিতে পেরে নিজের ওপর অন্ধ আক্রোশে অক্ষম রাগে কষ্ট পাবে, বুলেটের নিচে মাথা পেতে দেবে, কিন্তু মাথা নোয়াবে না! অন্যায়ের সাথে কোনোরকম আপোষ করবে না! অবাক হয়ে ভাবলাম- ভাগ্যিস মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেয়া ত্রিশ লক্ষ শহীদ বেঁচে নাই। আমার ধারণা- তারা একদিকে ই-আর্কাইভ বানিয়ে মুক্তিজুদ্ধে গৌরবের ইতিহাসকে সোনায় বাঁধিয়ে রাখার উৎসব আর অন্যদিকে দেশের আদিম অধিবাসীদের ওপর করা অন্যায় অবিচারকে গৌরবের ওপর কলঙ্কের মতন লাগতে দেখে সম্ভবত নিজেরাই আত্মহত্যা করত!
আদিবাসী মানে একটা দেশের আদিম অধিবাসী। মানে কলম্বাস নামের লোকটি যতদিন আমেরিকা আবিষ্কার করেনি তখনো যারা সেই দেশে কলম্বাস আসার আগে থেকেই ছিল, সেই রেড ইন্ডিয়ানরা আমেরিকার আদিম অধিবাসী। সেরকম বাংলাদেশের আদি অধিবাসী হচ্ছে সাঁওতালরা। তাদেরকে বাঙালিদের নিজের মুখে ‘উপজাতি’ বলাটা খুবই উৎকট শোনায়। উল্টো বাংলাদেশে অবস্থানকারী বাঙালিরাই বরং একরকম সাঁওতালদের উপজাতি! কাজেই আদিবাসীদের উপজাতি বলাটা শুধু কাণ্ডজ্ঞান না, মূর্খতার চরম প্রকাশ!
জাহাঙ্গীরনগরের র্যাগিং নিয়ে মুখ খোলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাত যাওয়ার ধুনো তুলে কাণ্ডজ্ঞানহীন কিছু লোকের প্ররোচনায় মানববন্ধনও হয়ে গেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে বের করে দেবার। কারণ- আমার অপরাধ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যায় ক্ষমতার অধিকারীদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। একটি অন্যায় বহুদিন ধরে লালন পালন করলে অসুবিধা নেই, কিন্তু যেইমাত্র তুমি প্রতিবাদ করবে অমনিই মানসম্মান চলে যাওয়ার নির্লজ্জ খোঁড়া যুক্তিটি প্রদর্শন করা হবে! যেন ধর্ষণ করলে দোষ হবেনা, কিন্তু ধর্ষণের সময় চিৎকার করলে দোষ হবে!
তবুও শিরদাঁড়া উঁচু করে আমি প্রতিদিন ক্লাসে যাই, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ দিয়ে নির্ভয়ে হাঁটি। কারণ এই হাঁটার যোগ্যতা আমি নিজে অর্জন করেছি ভর্তি পরীক্ষা নামের প্রতিযোগিতাটার পর। সেই অধিকার কেড়ে নেবার ক্ষমতা শুধু তাদেরই আছে যারা সেই যোগ্যতার কৃতিত্ব আমাকে দিয়েছিলেন!
কাজেই মাখন বার্গার খাওয়া, দেশের খোঁজ খবর না রাখা কিউট ছেলেমেয়েরা, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা গুলুগুলু ছেলেমেয়েরা, দয়া করে চোখ খোলো। দেশের আদি অধিবাসীরা ভালো নেই, তোমরা কীভাবে ভালো থাকছ? কীভাবে রাতের পর রাত দুর্বিষহ হচ্ছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটা অংশের মানুষের জীবন, তা জেনেও চুপ থাকছ! তোমরা কি তরুণ? না মেরুদণ্ডহীন পোকামাকড়! তোমরা কি মানুষ, নাকি মানুষরূপী অ-মানব?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক বন্ধু তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানিয়েছে (তার স্ট্যাটাস হুবহু তুলে দিলাম)- ‘সারি লাইফ বেশারমি কী নাইট’- শহীদ মিনারের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগডে পালনকারী অনার্স ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থীদের মাইকে বাজানো গান! এটি একটি হিন্দি ভাষার গান, যার অর্থ হচ্ছে- পুরো জীবন নির্লজ্জতার একটি রাত!
সেই বন্ধুকে বললাম- এসব লিখোনা, আমার মতন মানববন্ধন হবে তোমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে!
পরে দেখলাম- যারা শহীদ মিনারের সামনে তাদের পুরো জীবন নির্লজ্জতার একটি রাত বলে জানান দিচ্ছে তারা ঠিকই বলেছে অকপটে! আসলেই এই জাতির বেশরম, নির্লজ্জ, মাথামোটা ও মেরুদণ্ডহীন একটা অংশ তৈরি হয়েছে। যাদের প্রতিনিধি হয়ে আমি বেঁচে থেকেও বারবার শরমে এবং মরমে মরে যাচ্ছি! কারণ- ঘুরেফিরে মানুষ আমরা সবাই, পার্থক্য শুধু শিরদাঁড়ায়!
মাত্র কয়েক বর্গএকরে বাস করা এই সাঁওতালদের থেকে মেরুদণ্ড গজানোর বিদ্যাটা শেখার আছে একলক্ষ ছাপ্পান্নহাজার বর্গমাইলের এই রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের। কীভাবে এগারোদিন কেটে গেলেও বস্ত্রহীন, অন্নহীন, বাসস্থান এবং নিরাপত্তাহীন দিন কাটাবার সাহস অর্জন করতে হয়- সেই বিদ্যা শেখার ধ্যান শেখার আছে এদেশের প্রতিটি তরুণের। এদেশে বাস করা এক লক্ষেরও কম সাঁওতাল আদিবাসীদের কাছে শেখার আছে এদেশে বাস করা প্রায় একুশ কোটি বাঙালীর।
লেখক: তরুণ লেখক ও সাহিত্যিক