বাঙালির সংকট এবং সম্ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শন
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০১৬, ২২:৪১
যুগে যুগে বাঙালির উপরে নেমে এসেছে নানা সংকট। ভৌগোলিক ভাবে এদেশের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এ অবস্থানের কারণে নানাভাবে বিদেশি শত্রুর দ্বারা বিপর্যস্ত হয়েছি। বাইরের শত্রুরাই যে শুধুমাত্র আমাদের ক্ষতি করেছে তা না। ঘরশত্রু বিভীষণরাও তাদের নিজেদের অপরিমেয় লোভ এবং লালসার জন্য এদেশের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচেছিলেন ব্রিটিশদের শাসনামলে তিনি দেখেছেন এ দেশের মানুষের উপরে শোষক শ্রেণির নির্মম অত্যাচার। তিনি নানাভাবে নীরবে নিভৃতে এর বিরুদ্ধ অবস্থান থেকে কথা বলেছেন।
যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরোপুরি রাজনীতিবিদ ছিলেন না তার পরেও ভারতবাসির সংকটে আমরা তাঁর গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাই। এই প্রজ্ঞার পরিচয় পাই তাঁর প্রবন্ধ, উপন্যাস চিঠিপত্র এবং নাটকে। এইসব রচনায় তাঁর রাজনৈতিক দর্শন প্রতিভাত। তাঁর এই রাজনৈতিক দর্শন যুগে যুগে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের পথ নির্দেশ হিসেবে আলোচিত হতে পারে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংকট এবং সদিচ্ছায় রবীন্দ্রনাথকে আমরা অনুসরণ করতে পারি। যেহেতু তিনি মিশে আছেন আমাদের চিন্তায়, আমাদের ভাবনায়, আমাদের অস্তিত্বের গভীর সত্তায়।
ব্রিটিশ শাসন আমলে ব্রিটিশবিরোধি আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন রকম আন্দোলনে বিক্ষোভসহ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিলেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি কোন বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়নি বলে জনশ্রুতি রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। কিছু কিছু বিশেষ ঘটনা ছাড়া শাসক শ্রেণি সব সময় তাঁর এই সংশ্লিষ্টতার কথা গোপন করে গেছে, অথবা আলোচনার বাইরে রেখেছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন যুগাতিক্রমী দার্শনিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ছিলেন; তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দর্শনসমৃদ্ধ প্রবন্ধ, ভাষণ পড়লে এটা বোঝা যায়। এ কারণেই বাঙালির ক্ষোভ, বিক্ষোভ এবং বাঙ্গালির সংকট মুক্তির পথ প্রদর্শক রূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তা যুগে যুগে আলোচিত হতে পারে।
নিজ মাতৃভূমি বা দেশ সম্বন্ধে তার চিন্তাভাবনার জায়গাটি ছিল আলাদা। তিনি শান্তি নিকেতনের দশম বার্ষিক উৎসবে একটি ভাষণ দেন, যা ‘দেশের কাজ’ নামে প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি বলেছেন ‘দেশের কাজ’ মানে শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। তাঁর কাছে স্বদেশ বলতে নিজের দেশের লোক এবং দেশের কাজ বলতে বুঝাতেন দেশের সর্বহারাদের জন্য কাজ করাকে বুঝতেন।
তিনি আরও বলেছিলেন-
দেশ মানুষের সৃষ্টি, দেশ মৃন্ময় নয় দেশ চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয় তবেই দেশ প্রকাশিত। সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা ভূমির কথা যতই উচ্চকণ্ঠে রটাব ততই জবাবদিহির দায় বাড়বে, প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দান তো উপাদান মাত্র, তা নিয়ে মানবিক সম্পদ কতটা গড়ে তোলা হল। মানুষের হাতে জল যদি যায় শুকিয়ে, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে মারীবীজে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্যকথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে তৈরি নয়, মানুষের তৈরি।”
দেশের সম্বন্ধে এই কথাটি যুগে যুগে অর্থবহ হওয়ার মত বিষয়। দেশের মূল সম্পদ মানুষ এবং দেশের কাজ মানে মানুষের জন্য কাজ। মানবতাবাদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় যে সত্যটি অনুযায়ী দেশের নেতাদের পথ চলতে বলেছেন তার মূল্য অপরিসীম।
ধর্ম সম্বন্ধেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন পরিষ্কার ছিল। ভারতবর্ষ যেন ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত হয় এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐকান্তিক প্রত্যাশা ছিল। গোরা উপন্যাসে তিনি এক জায়গায় বলেছেন, “ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত সাধনার জিনিস, তাকে কোন সমাজের সঙ্গে জড়িত করা উচিত না।” এই উপন্যাসে গোরা চরিত্র সৃষ্টি করে তিনি একটি বিস্ময়কর বিষয় দেখিয়ে দিয়েছেন তা হল : যে কোনও ধর্মে জন্মগ্রহণের এবং ধর্মচর্চার অন্তসারশূন্যতার বিষয়টি।
ধর্মচর্চা সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য আরো সুস্পষ্ট করে বোঝা যায় কবির পারশ্য ভ্রমণের একটি ঘটনা থেকে। পারস্য ভ্রমণের সময় কবি সরকারের কাছ থেকে শেখ সাদি রচিত একটি প্রাচীন হাতে লেখা গ্রন্থ উপহার পান। এ সময় যাত্রাপথে কবি হাফিজের কবর পড়ে যায়। কবির মনে পড়ে যায় পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হাফিজের অনুরাগী ভক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকেই তাঁর পিতার কাছ থেকে কবি হাফিজের কবিতার আবৃত্তি ও তর্জমা শুনেছেন। কবি নিজেও সেই থেকে মসলমান কবি হাফিজের অন্ধ অনুরাগী ছিলেন। একটি ঘটনার কথা জানা যায় যা থেকে ধর্ম বিষয়ে তাঁর মনোভাব সুস্পষ্ট হয়।
“হাফেজের কবরস্থানে সমাধিরক্ষক হাফেজের গ্রন্থ আনিয়া কবিকে খুলিতে বলিল। সেখানকার লোকদের বিশ্বাস এই যে যে- কোনো একটি বিশেষ ইচ্ছা মনে লইয়া চোখ বুজিয়া এই গ্রন্থ খুলিলে যে কবিতাটি বাহির হইবে তাহা হইতে ইচ্ছার সফলতা নির্ণয় হইবে।”
কবিও তাহাই করিলেন। তথায় আসিবার পূর্বে গভর্নরের সহিত ধর্মান্ধতা সম্বন্ধে কবির যে কথাবার্তা হইতেছিল সেইটাই মনে জাগিতেছিল। তাই মনে মনে ইচ্ছা করিলেন ধর্মনামধারী অন্ধতার প্রাণান্তিক ফাঁস থেকে ভারতবর্ষ যেন মুক্তি পায়। যে পাতা বাহির হইল তাহার কবিতার দ্বিতীয় অংশের অংশ হইতেছে- “স্বর্গদ্বার যাবে খুলে, আর সেই সঙ্গে খুলবে আমাদের সমস্ত জটিল ব্যাপারের গ্রন্থি, এও কি সম্ভব। অহংকৃত ধার্মিক নামধারীদের জন্য যদি তা বন্ধই থাকে তবে ভরসা রেখো মনে ঈশ্বরের নিমিত্তে তা যাবে খুলে। বন্ধুরা প্রশ্নের সাথে উত্তরের সঙ্গতি দেখে বিস্মিত হলেন”।
ধর্ম বিষয়ে বাড়িবাড়ির প্রবলতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিরুদ্ধে। তিনি বিষয়টিকে চিহ্ণিত করেছেন ধর্মতন্ত্র বলে। কালান্তরের কর্তার ইচ্ছায় কর্ম প্রবন্ধে ধর্মতন্ত্র বিষয়ে তাঁর চিন্তার এই বিশেষ দিকটির প্রতি একটু মনোযোগ দিতে পারি। “সমাজের সকল বিভাগেই ধর্মতন্ত্রের শাসন এক সময় ইউরোপেও প্রবল ছিল। তারই বেড়জালটা কাটিয়া যখন বাহির হইল তখন হইতেই সেখানকার জনসাধারণ আত্মকর্তৃত্বের পরে যথেষ্ঠ লম্বা করিয়া পা ফেলিতে পারিল”।...
ধর্মতন্ত্র বলিতে যা বোঝায় ইংলন্ডে আজও তার চিহ্ণ নাই, এমন কথা বলি না। কিন্তু বড়োঘরের গৃহিনী বিধবা হইলে যেমন অবস্থা হয় তার অবস্থা তেমনি। একসময় যাদের কাছে সে নথ নাড়া দিয়াছে, ন্যায়ে অন্যায়ে আজ তাদেরই মন জোগাইয়া চলে; পাশের ঘরে তার বাসের জায়গা, খোরপোশের জন্য সামান্য কিছু মাসোহারা বরাদ্দ। হালের ছেলেরা পূর্বদস্তুর মত বুড়িকে হপ্তায় হপ্তায় প্রণাম করে বটে, কিন্তু মান্য করে না। এই গৃহিনীর দাবরাব যদি পূর্বের মত থাকিত তবে ছেলে-মেয়েদের কারো আজ টু শব্দটি করবার জো থাকিত না।
তিনি বলেছেন যে ধর্মতন্ত্র যদি মানুষের তুলনায় বড় হয়ে ওঠে তাহলে একটি সংকট সৃষ্টি হয়।
“ধর্ম আর ধর্মতন্ত্র এক জিনিস নয়।”
“ধর্ম বলে, মানুষকে যদি শ্রদ্ধা না কর তবে অপমানিত ও অপমানকারী কারো কল্যাণ হয় না। কিন্তু ধর্মতন্ত্র বলে, মানুষকে নির্দয়ভাবে অশ্রদ্ধা করিবার বিস্তারিত নিয়মাবলী যদি নিখুত করিয়া না মান তবে ধর্মভ্রষ্ট হইবে। ................ ধর্ম বলে, যে মানুষ যথার্থ মানুষ সে যে ঘরেই জন্মাক পূজনীয়। ধর্মতন্ত্র বলে সে যতবড়ো অভাজনই হোক, মাথায় পা তুলিবার যোগ্য। অর্থাৎ মুক্তির মন্ত্র পড়ে ধর্ম, আর দাসত্বের মন্ত্র পড়ে ধর্মতন্ত্র।”
এইসব বিষয়ে আলোকপাতের কারণ হল এই যে , রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানবতাবাদে বিশ্বাসি। ধর্মতন্ত্রের অপব্যবহারে সামষ্টিক বিচ্ছিন্নতা, শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি দেশের মানুষের সমাজমানসে ঐক্য সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসব বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তাঁ মানবতাবাদী মতামত ব্যক্ত করেছেন।
গোরা উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। এখানে রবীন্দ্রনাথের দেশ ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়।
এখানে তিনি একস্থানে বলেছে “ইতোপূর্বে দেশ বলে আমাদের সমস্ত দেশকে , জাতি বলতে আমাদের সমস্ত জাতিকে এক করে দেখতে পারিনি। সেইজন্যই তার শক্তি জাগেনি। একসময় রোগীর দিকে না তাকিয়ে তাকে বিনা চিকিৎসায় বিনা পথ্যে ফেলে রাখা হয়েছিল। এখন তাকে ডাক্তারখানায় আনা হয়েছে বটে, কিন্তু ডাক্তার তাকে এতই অশ্রদ্ধা করে যে একে একে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো দীর্ঘ শুশ্রষাসাধ্য চিকিৎসা সম্বন্ধে সে ধৈর্য ধরে বিচার করে না।” এখানে বঙ্গভঙ্গের বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত গান-
“বাংলার মাটি বাংলার জল,
বাংলার ফুল বাংলার ফল
এক হোক এক হোক
এক হোক হে ভগবান”
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি ও তাই।
দেশ এবং রাজনীতি সম্বন্ধে চিন্তায় তিনি ছিলেন সারা ভারত বর্ষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তিত। দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন, শ্রেণি বৈষম্যজনিত বিভাজন, হিন্দু ধর্মের মধ্যে বর্ণ বৈষম্যগত বিভাজন। এ ছাড়া ও রয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রের আলাদা আলাদা মাধ্যমে শিক্ষার জন্য চিন্তার ঐক্যের অভাবে সৃষ্ট বড় রকমের চেতনাগত বৈষম্যর সংকট। দেশের মানুষের মানসিক উন্নতির জন্য শিক্ষা ভাবনাও ছিল রাজনৈতিক চিন্তার অঙ্গীভূত বিষয়।
এ প্রসঙ্গে জাপান ভ্রমণের সময় তিনি যা বলেছিলেন তার বিষয়বস্তু হলো-
দেশে অভ্যন্তরীণ অশান্তি হলে দেশকে সম্পূর্ণভাবে গড়ে তোলা কঠিন। দলীয় রাজনীতি এবং ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে উঠে দেশের মানুষের জন্য সার্বিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। দেশাত্মবোধ পারস্পরিক সহানুভূতি সহযোগিতা এবং মানবিক শিক্ষা দিয়ে যুব সমাজের মানসিক উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি অসম্ভব। সারা ভারতবর্ষে তখন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন চলছিল। তবুও তিনি এই সমস্ত মতামত প্রকাশ করছিলেন।
পূর্বেই বলেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়নি, কিন্তু মানুষের উপর ব্রিটিশদের অত্যাচার যখন তীব্র হয়েছে তখন তিনি একেবারে চুপ করে থাকেননি। ব্রিটিশদের শাসন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য উনিশশো ৩০-৩১ সালে দেশের শত শত যুবককে এই কারণে দেশের বিভিন্ন জেলে বন্দী করা হয়েছিল (হিজলি জেল ভূটান সীমান্তের বকশ দূর্গ ও রাজপুতনায় মরুভূমির মধ্যের দেওলি দূর্গ) এর মধ্যে হিজলির দূর্গ যেখানকার শাস্ত্রীরা বন্দীদের উপর অত্যাচার করে, এই অত্যাচারের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ বিপ্লবীরা জেলখানায় বিদ্রোহ করে। এটা আলিপুরের বোমা হামলায় আসামী কলিকাতার সন্তোষ মিত্র এবং বরিশালের তারকেশ্বর দত্ত সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ( ১১ই সেপ্টেম্বর)
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য লক্ষাধিক লোকের সামনে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতির প্রতিভু হিসেবে তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এখানে তিনি বলেছিলেন, ”এই যে হিজলীর গুলি চালানোর বিষয়, তার শোচনীয় কাপুরুষতা ও পশুত্ব নিয়ে যা কিছু আমার বলবার সে কেবল মনুষ্যত্বের দিকে তাকিয়ে।”
এখানে তিনি আরো বলেছিলেন, “যখন দেখা যায় জনতাকে অবজ্ঞার সঙ্গে উপেক্ষা করে এত অনায়াসে বিভীষিকার বিস্তার সম্ভব হয় তখন ধরে নিতেই হবে যে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের চরিত্র বিকৃতি হয়েছে, এবং এখন থেকে আমাদের ভাগ্যে দুর্দাম দৌরাত্ম উত্তরোত্তর বেড়ে চলবার আশংকা ঘটল। যেখানে নির্বিবেচক অপমান ও অপঘাতে পীড়িত হওয়া দেশের লোকের এত সহজ, অথচ সেখানে যথোচিত বিচারের ও অন্যায় প্রতিকারের আশা এত বাধাগ্রস্ত সেখানে প্রজা রক্ষার দায়িত্ব যাদের পরে , সেই সব শাসনকর্তা এবং তাদেরই আত্মিয় কুটুমদের শ্রেয়বুদ্ধি কলুষিত হবেই এবং সেখানে ভদ্র জাতীয় রাষ্ট্রবিধির ভিত্তি জীর্ণ না হয়ে পারেই না।”
তিনি এই সভায় আরো বলেছিলেনঃ” এই সভায় আমার আগমনের কারণ আর কিছুই নয় আমি আমার স্বদেশবাসীর হয়ে এই বলে সতর্ক করতে চাই যে বিদেশিরাজ যত পরাক্রমশালি হোক না কেনো আত্মসম্মান হারানো তার পক্ষে সবচেয়ে দুর্বলতার কারণ, এই আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠা ন্যায়পরায়ণতা ক্ষোভের কারণ সত্ত্বেও অবিচলিত সত্যনিষ্ঠায় প্রজাকে পীড়ন স্বীকার করে নিতে বাধ্য করানো রাজার পক্ষে কঠিন হতে না পারে , কিন্তু বিধিদত্ত অধিকার নিয়ে প্রজার যখন স্বয়ং রাজাকে বিচার করে তখন তাকে নিরস্ত করতে পারে কোন শক্তি? এ কথা ভুললে চলবে না যে প্রজার অনুকূল বিচারও আন্তরিক সমর্থনের ‘পরেই অবশেষে বিদেশি শাসনের স্থায়িত্ব নির্ভর করে।”
তিনি আরো বলেনঃ বেআইনি অপরাধকে অপরাধ বলেই মানতে হবে, এবং তার ন্যায়সঙ্গত পরিণাম যেন অনিবার্য হয় - এইটি ই বাঞ্ছনীয়। অথচ এ কথাও ইতিহাস বিখ্যাত যে যাদের হাতে সৈন্য বলো রাজপ্রতাপ অথবা আরা এই শক্তির প্রশ্রয়ে পালিত তারা বিচার এড়িয়ে এবং বলপূর্বক সাধারণের কণ্ঠ্ রোধ করে ব্যাপকভাবে এবং গোপন প্রণালিতে দুর্বৃত্ততার চূড়ান্ত সীমায় যেতে কুণ্ঠিত হয়নি। কিন্তু মানুষের সৌভাগ্যক্রমে এরূপ নীতি শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারে না।
‘’ পরিশেষে আমি গবর্মেন্টকে এবং সেই সঙ্গে আমার দেশবাসিগণকে অনুরোধ করি যে অন্তহীন চক্রপথে হিংসা ও প্রতিহিংসার যুগল তাণ্ডবনৃত্য এখনি শান্ত হউক। ক্রোধ ও বিরক্তিকে বাধামুক্ত করে দেওয়া স্বাভাবিক মানব প্রকৃতির পক্ষে স্বাভাবিক সন্দেহ নেই কিন্তু এটা শাসক শাসয়িতা কারো পক্ষেই সুবিজ্ঞতার লক্ষণ না। এ রকম উভয় পক্ষে ক্রোধোম্মত্ততা নিরতিশয় ক্ষতিজনক, এর ফলে আমাদের দুখ:ও ব্যর্থতা বেড়েই চলবে এবং তা শাসন কর্তাদের নৈতিক পৌরুষের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস হানি ঘটবে - লোকসমাজে এই পৌরুষের প্রতিষ্ঠা তার ঔদার্যের দ্বারাই সপ্রমান হয়।
তিনি দেশের বিরুদ্ধ স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিষয়ে বলেছেন-
আমাদের দেশে অন্ধকার রাত্রি। মানুষের মন চাপা পড়ছে। তাই অবুদ্ধি দুর্বুদ্ধি ভেদবুদ্ধিতে দেশ পীড়িত। আশ্রয় বলতে যা কিছু অল্প মাত্র গড়ে তুলি তাই নিজের মাথার উপর ভেঙে পড়ে। আমাদের শুভ চেষ্টাও খণ্ড খণ্ড হয়ে দেশকে কেবলি আঘাত করছে। আত্মীয়কে আঘাত করবার আত্মঘাত যে কী সর্বনেশে, উন্মত্ততায় সেকথা আমরা বুঝেও বুঝিনে। যে শিক্ষা লাভ করছি ভাগ্যদোষে সেই শিক্ষাই বিকৃত হয়ে আমাদের ভ্রাতৃবিদ্বেষের অস্ত্র যোগাচ্ছে।
শেষে তিনি যা বলেছেন তাতে যুগে যুগে অনুসরণীয় আদর্শ হতে পারে। তিনি বুঝেছিলেন তারুণ্যই ভারতবর্ষের রাজনীতির মূল শক্তি।
সর্ববঙ্গ মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীর প্রতি লিখিত ভাষণে তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন-
“আজ অন্ধকার রাত্রির অবসান হোক তরুণদের নবজীবনের মধ্যে। আচারভেদ মতভেদ ধর্মভেদ ,স্বার্থভেদের সমস্ত ব্যবধানকে বীরতেজে উত্তীর্ণ হয়ে তারা ভ্রাতৃপ্রেমের আহ্বানে নবযুগের অভ্যর্থনায় সকলে মিলিত হোক। দুর্বল যে সেই ক্ষমা করিতে পারে না, বলিষ্ঠ তারুণ্যের ঔদার্য সকল প্রকার কলহের দীনতাকে নিরস্ত করে দিক। সকলে হাত মিলিয়ে দেশের সর্বজনীন কল্যাণকে (common wealth) অটল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করি।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষা এবং বাঙালিকে এনে দিয়েছেন আত্মসম্মান, আত্মগৌরবের অধিকার। আজ আমাদের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটা বহু পূর্বেই যে সংকট সৃষ্টি হচ্ছিল সে সম্বন্ধে তিনি তাঁর মতামত দিয়েছেন। তরুণদের বিষয়ে তিনি ছিলেন আশাবাদী। তারুণ্যকে যথার্থভাবে শিক্ষার মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে গড়ে তুলবার ইচ্ছা তাঁর লেখায় ব্যক্ত হয়েছে। সার্বজনীন কল্যাণাকাঙ্ক্ষা তাঁর উন্নত রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই পরিচয় বহন করে। তাঁর প্রতি সম্মান জানাতে তাঁর বিপুল কাজের মধ্য থেকেই আমাদের প্রয়োজনে তাঁর দর্শনকে উপলব্ধি করে আমরা এক একটি সময়ে সংকট মুক্তির পথ খুঁজবো।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা