বিপর্যস্ত তারুণ্য এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা
প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০১৬, ২১:৫১
শিশুরাই বাবা মায়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তেমনি একটি রাষ্ট্রের একজন নেতার প্রধান সম্পদ হল তার দেশের তারুণ্যের কর্মশক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি। এই যৌথশক্তির যথাযথ ব্যবহারেই নিহিত থাকে একটি জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি এবং কল্যাণ।
আমাদের এলাকায় একজন লোকের একে একে অনেকগুলি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করছিল। সেই ভদ্রলোকের একজন বন্ধু এসে বললেন, "এতগুলি মেয়ে বিয়া দিবা ক্যামনে? কোনো বিল্ডিং বা টাকা পয়সা তো জমাও নাই, কী করবা শেষে? কন্যার জন্মদাতা বললেন, "কন্যারাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, এক একজন আমার একটা করে একশতলা বিল্ডিং; শুধু তাই নয় এরা হবে সারা দেশের সম্পদ। এরা যদি ঠিকমত মানুষ না হয় তাইলে বড় বড় দালানকোঠা করে যা লাভ হবে তা ধ্বংস হতে বেশি সময় লাগবে না"। এই কথাটি পুত্রসন্তানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
আমাদের দেশটা খুব বড় নয়। এর সম্পদ সীমিত। এদেশের মানুষের অর্জিত অর্থ ফিলিপাইনের জুয়ার টেবিলে গড়াগড়ি খায়, কেন গড়াগড়ি খায় কেউ তার খবরও ঠিকমতো জানে না। কিন্তু এ দেশের যুবকরা চাকরি খোঁজ করেও পায় না। যারা পায় তাদের সংখ্যা খুব নগণ্য। কর্মসংস্থান যুবকদের একটি জরুরী বিষয়। দেশি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে এদেশে কর্মসংস্থানের যে সুযোগ ছিল তা শেয়ার মার্কেটের বিপর্যয়ে এবং দেশীয় ও বাইরের অপতৎপরতায় ধ্বংস হলো। পুঁজিবাজার দেশের একটি প্রধান অর্থশক্তি। পুঁজিবাজারের সেই বিষয়টির দিকে নজরদারি বাড়ালে দেশের অনেক উন্নতি হতে পারতো, এতে তরুণদের মধ্যের হতাশাও দূরীভূত হতো।
দিনে দিনে আমাদের শিশু কিশোর এবং তরুণদের বহু রকমের মানসিক ক্ষতি হচ্ছে যা আমরা অনুভব করতে পারছি না কিন্তু এক সময় দেখি আমাদের সন্তান, আমাদের আশার আলো, আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ সম্পদ চলে গেছে অন্য কারো নির্দেশনার দখলে। তখন আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। কোথাও সৃষ্টি হয় ঐশী, কোথাও সৃষ্টি হয় ফাহিম, কোথাও সৃষ্টি হয় নিব্রাস এবং অন্যান্যরা।
কত রকমের সর্বনাশ যে হতে পারে আমাদের সন্তানের, সে কথার শেষ নেই। কিন্ত আমাদের শৈশবের কথা যদি ভাবি তাহলে দেখতে পাই স্বাভাবিকভাবে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, অক্সিজেন পেয়েছি বাতাসে প্রচুর। বাবা-মা যা কিছু খাওয়াতেন তাতে রাসায়নিক বিষ ছিল না। এখন আমরা সন্তানদের যা খাওয়াই সর্বত্রই বিষ খাওয়াই। শিশুখাদ্য হিসেবে যাই তুলে দিচ্ছি তাতেই বিষ। দুধে বিষ, ডিমে বিষ, গম পচা অখাদ্য, চাল প্লাস্টিক, ফলে বিষ, মাছে ফরমালিন এবং অন্যান্য বিষ।
আমাদের ছোটবেলার কথা মনে আছে, মা যদি একটু বাইরে থাকতেন তাহলে আমাদের মনে যে কী কষ্ট হতো সেটা বলে শেষ করা যাবে না। এখনকার মায়েরা তো সন্তানকে অতটা সঙ্গ দিতে পারেন না, তার বিনিময়ে সন্তানটি থাকে গৃহপরিচারিকা অথবা অন্য কারো তত্ত্বাবধানে। সেখানে তাদের খাওয়া নাওয়া ঘুমসহ অনেক কিছুই একটা সুস্থিতির মধ্য দিয়ে সম্পাদিত হয় না। এরপরে আসি লেখাপড়া বিষয়ে যা একেবারে দোলনা থেকেই শুরু হয়। শৈশব তো অনেক পরের কথা। এরপর থেকেই শুরু হয় কোচিং এর চাপ, পিঠে বইয়ের বোঝার চাপ, ধর্মীয় নীতি- শৃংখলা শেখানোর চাপ, ইংরেজি শিক্ষার চাপ, বিজ্ঞান শেখানোর চাপ, 'কেন পারছো না?' বলে বাবা মায়ের নির্মমতার চাপ, শিক্ষকদের চাপ, বেশি নম্বর পাওয়ার একটা ভয়ানক অমানবিক মানসিক চাপ। যে স্কুলে চাপ নেই সেই স্কুলে ভর্তি করে বাবা-মা আনন্দ পান না। তারা মনে করেন সন্তানকে যত চাপে রাখা যায় ততই ভালো। সুশিক্ষাটা তাতে ভালোভাবে হবে বলে তাদের মনে হয়। আর পরীক্ষা পদ্ধতির রকমফের, প্রশ্নপত্র ফাঁস, না পড়ে বেশি নম্বর পাওয়া, মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ, চাকরির সুযোগ ইত্যাদি দেখে দেখে ছেলেমেয়েরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ এই অবস্থায় নেশাগ্রস্ত হয়ে ব্যক্তিগত যন্ত্রণা ভুলে থাকার চেষ্টা করে।
আমাদের এইসব সার্বিক অব্যবস্থাপনা অসততা দেখে দেখে তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি এবং নিজের অভিভাবকদের প্রতি। নিজের সুখের আবাসও তাদের আর টানে না। ঠিক সেই সময়ে যদি কেউ উস্কানিমূলক বা মিথ্যা ন্যায় নীতির প্রতিষ্ঠাকল্পে একটি হিংসাত্মক বিপ্লব নিয়ে এগিয়ে আসে ত্রাণকর্তা রূপে অথবা নতুন যাদুমন্ত্রের আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে নিয়ে, তাহলে সোজাসিধা সাধারণ ছেলেদের বাগে নিতে কি বেশি কষ্ট করতে হয়? আর যারা বিত্তবানদের ছেলে তারা তো বাইরের শক্ত পৃথিবীটা চেনেই না।
সম্প্রতি গুলশানে আর্টিজান হোটেলে জঙ্গী হামলা এদেশের তরুণদের ভাগ্যলিপিতে একটি বিরাট মসীলেখা হিসেবে খোদাই হয়ে থাকবে। এ থেকে পুরো দেশকে এবং আমাদের তারুণ্যের অপরিমেয় শক্তিকে রক্ষা করার জন্য নানা উপায় বের করতে হবে। দেশ ও জাতির কল্যাণার্থে নতুন করে এদেরকে ঐক্যের বন্ধনে গেঁথে রাখার জন্য নানা কর্মকৌশলের উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। জাতি হিসেবে আমরা একটি উন্নত বিপ্লবী জাতি। মুক্তিযুদ্ধের ফসলকে আমরা গুটি কয়েক জঙ্গীর অপকর্মের জন্য হারাতে পারি না। ঐক্যবদ্ধভাবে তারুণ্যকে সুশিক্ষা দিলে এই কলঙ্ক ধুয়ে ফেলা সম্ভব। এ জন্য সবচেয়ে যেটা বেশি দরকার তা হল শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে একমুখী এবং কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করার। ভাল শিক্ষকই পারেন এই অবস্থায় জাতির হাল টেনে ধরতে। সেই রকম নিবেদিত শিক্ষক খুঁজে বের করতে হবে। সেই রকম আদর্শবান আত্মনিবেদিত শিক্ষক বিভিন্ন স্কুল কলেজে ঘুরে ঘুরে নৈতিকতা এবং মানুষকে ভালবাসার কথা বলবেন। তার আগে ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এইসব প্রচেষ্টা চালাতে হবে জাতিকে রক্ষার জন্য। না হলে আমাদেরকে দিয়েই আমাদের ধ্বংস করার সার্বিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করার আর কোনো উপায় থাকবে না।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা