নারীর সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণে নূরজাহান বেগমের বেগম পত্রিকা

প্রকাশ : ০১ জুন ২০১৬, ১৭:৩৭

সাহিত্যচর্চা মানুষের মধ্যে একটি সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলে। এই বন্ধনের শক্তি পৃথিবীর অন্য যে কোন বন্ধনের থেকে শক্তিশালি। সাহিত্য পত্রিকার কাজই হল মানুষে মানুষে এই বন্ধনের গ্রন্থি সৃষ্টি করা। কিন্তু কাজটি খুব সহজ নয়। খুব বেশি ভাল মানের সাহিত্য পত্রিকা এখনও নিয়মিত হতে পারেনি।স্বাধীনভাবে মানুষের মতামত এবং পত্র পত্রিকা প্রকাশে সব সময়ই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য বহু ধরনের বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু নূরজাহান বেগমের বেগম পত্রিকাটি নারীদের কাছে পৌছে যেত একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংস্কারমুক্তির বার্তাবাহি মুখপত্র হিসেবে। এর গুরুত্ব একেবারে কম নয়।

আমাদের শৈশব কেটেছে সাহিত্যচর্চার মধ্যে যাঁরা নিবেদিত ছিলেন তাঁদেরকে দেখতে দেখতে, তাঁদের নানা রকম সাহিত্য এবং সাহিত্যিক বিষয়ক আলোচনা শুনতে শুনতে।

অনেক সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক কবি আমাদের বাসায় আসতেন। মামা শামসুদ্দিন আবুল কালাম ছিলেন তখন অসাধারণ নামকরা সুসাহিত্যিক। যাঁর নাম ছিল তখনকার মানুষের মুখে মুখে। তাঁর বোন হিসেবে মা ছিলেন একজন সাহিত্যবোদ্ধা এবং নিজেও একজন লেখক। তখন সাহিত্যিক মামার গল্প শুনতে অনেক মানুষই বাসায় আসতেন। আমার ছোট খালা সাইদা পারভীন খুকুও ভাল কবিতা লিখতেন, যা বেগম পত্রিকাসহ অন্যান্য পত্রিকায় ছাপা হত। তাঁরা যখন কথা বলতেন তাদের অনেক খণ্ড খণ্ড কথা এখনও কানের কাছে ভেসে বেড়ায় যা বোঝার মতো বয়স তখনো হয়নি। এই সময় আমাদের বাড়িতে মা নূরজাহান বেগম সম্পাদিত বেগম পত্রিকাসহ আরো কিছু পত্রপত্রিকা রাখতেন। পত্রিকাটির সাইজ এবং প্যাটার্ন তখনকার মানুষদের কারোই অজানা নয়। পত্রিকাটি হাতে আসার সাথে সাথে মায়ের মুখের হাসি একটি তীক্ষ্ণ দ্যুতি ছড়াতো। মনে হতো বেগম পত্রিকাটি যেন অন্তপুরের নারীদের জন্য একটি বিপ্লবী মুক্তির বার্তা হিসেবে সোনার পায়রা হাতে তুলে দিতো। মায়ের মনটি তখন হারিয়ে যেতো কোথায়? সেই বেগম পত্রিকার পাতার ভাঁজে ভাঁজে। মা গেয়ে উঠতেন গান " যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইবো কত আর।"

বেগম পত্রিকা ছিল নারী জাগরণের একটি প্রধান মাধ্যম যাকে অগ্রদূত বললে খুব একটি ভুল হবে না। এতে কবিতা গল্প এবং অন্যান্য মহিলা বিষয়ক কথাবার্তা ফ্যাশন ছাড়াও একপাতায় শিশুদের ছবি ছাপা হতো। আমার ফেইসবুকের পেজে এক সহকর্মী ইডেন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা হক মোনালিসা’র ছবি দেখে মনে পড়ে গেল সেই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির কথা। আমি উল্টে পাল্টে শুধু শিশুদের ছবিগুলিই দেখতাম। শুধু তাই নয় আরো পত্র পত্রিকা বাসায় আসতো ললনা উল্টোরথ মা যুগধ্বনি পত্রিকা। সেগুলোর সাথে চিত্রালী পূর্বাণী সহ কত কাগজপত্র যে বাসায় মাকে পড়তে দেখেছি তার তুলনা নেই।

বেগমের সাথে সাথে আমাদের জন্য রাখা হতো টাপুরটুপুর, ধান শালিকের দেশ আরো কিছু রুশ পত্রপত্রিকা এবং ভারতীয় কিছু পত্রপত্রিকা। এইসব পত্র পত্রিকা তখনকার নারীরা পড়তেন এবং তাতে নিজেদের লেখা প্রকাশের চিন্তাভাবনাও করতেন। এটা ছিল রীতিমত বিস্ময়কর বিষয় যে মায়ের লেখা তৎকালীন বেগম, ললনা এবং মা পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। মায়ের নাম ছিল মমতাজ বেগম (দুলালী) সম্ভবত মায়ের লেখা কবিতাটির নাম ছিল ঈশ্বরকে। তখন ছিল পাকিস্তান আমল। মায়ের মধ্যে তখন একটি বিপ্লবী চিন্তার উন্মেষ ঘটে। যে কারণে তিনি অমন একটি কবিতা লিখতে পেরেছিলেন। এছাড়াও তিনি স্মৃতিচারণমূলক গল্প লিখেছিলেন যার নাম স্মৃতির আঁখরে।চৌদ্দই আগস্টের স্বাধীনতার প্রত্যাশা কেমন করে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল এখানে তাই প্রকাশিত ছিল। আমার এই কথা বলার উদ্দেশ্য হল বেগম পত্রিকার মাধ্যমেই নারীদের মধ্যে একটি আত্মসচেতনতার বোধ গড়ে ওঠে। মা এবং খালা সাইদা পারভীন খুকুর লেখায় হাতেখড়ি মূলত বেগম পত্রিকার মাধ্যমে। নারীদের মধ্যে এই রকম একটি পত্রিকার কর্ণধার হওয়া একটি রীতিমত বিশাল কর্মযজ্ঞের ব্যাপার। এর জন্য বহু অর্থের প্রয়োজন। নূরজাহান বেগম সেই অসাধ্য সাধন করেছেন তাঁর বেগম পত্রিকা সম্পাদনা করে।

ইসরাইল খান সংকলিত এবং সম্পাদিত পূর্ব বাংলার সাময়িক পত্র গ্রন্থে তিনি যা বলেছেন তা হলঃ "উনিশশো সাতচল্লিশ সনের কিঞ্চিত পূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা বেগম ঢাকায় স্থাপান্তরের পর এদেশে মহিলা সম্পাদিত,মহিলাদের জন্য প্রকাশিত পত্র পত্রিকার ধারার সূচনা হয়। বেগমের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন প্রখ্যাত কবি সুফিয়া কামাল।" তিনিই প্রথম বেগম পত্রিকা সম্পাদনা করেন বলে জানা যায়।

এই বেগম পত্রিকার সূত্র ধরেই আমাদের মা খালাদের সাহিত্যের হাতে খড়ি। নূরজাহান বেগমের সাথে খুব জরুরী প্রয়োজনে গবেষণার কাজে একদিন দেখা করেছিলাম। তখন আমি শামসুদ্দিন আবুল কালামের সমগ্র সাহিত্যকর্ম বিষয়ে পি. এইচ. ডি গবেষণায় ব্যস্ত ছিলাম। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁর বাবা নাসিরুদ্দিন সম্পাদিত সওগাতের শিশুদের সংখ্যায় শামসুদদীন আবুল কালামের লেখা ছাপা হয়। এই পত্রিকাগুলোর সন্ধানে তাঁর সাথে দেখা করি। তিনি খুঁজে রাখবেন বলে কথা দিয়ে ও শেষ পর্যন্ত আর দিলেন না। তবে তিনি তাঁর স্বামী রোকনুজ্জামানের লেখা বেশ কিছু বই আমাকে কেনার জন্য অনুরোধ করলেন। আমি কিনলাম। বুঝলাম বইগুলো কেউ কেনে না বলে তিনি জোর করে আমাকে ধরিয়ে দিলেন। আমিও ব্যাগে যা টাকা ছিল তা খরচ করে এলাম। তবে তাঁর ঋজু দেহভঙ্গি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। সময়টি হল দুহাজার ছয় বা সাতের দিকে। আরো প্রায় দশ বছর আগে। সেদিন বেশ কিছু বই এবং পত্র পত্রিকা কিনেছিলাম। সবচেয়ে যা মূল্যবান বিষয় ছিল তা হল শামসুদদীন আবুল কালাম এবং তাঁর স্ত্রী হোসনে আরা বিজু বা বিজন সম্পর্কীত গল্প। তিনি বললেন হ্যাঁ ও তো আমাদের ছোট ছিল। বিজু প্রথম দিকে মুখচোরা স্বভাবের লাজুক প্রকৃতির ছিল। ব্রাবোন কলেজে ও ছিল আমাদের জুনিয়র। পরে মঞ্চ নাটকে সে দুর্দান্ত অভিনয় করতো। যে যুগে মেয়েরা ছিল ঘরের কোনে আবদ্ধ সেই যুগে মঞ্চে অভিনয় করা ছিল দুঃসাহসিক কাজ। এই কাজটিই বিজু করেছিল। সে তখন শামসুদদীন ভাইয়ের প্রেমে পড়ে। তখন শামসুদদীন আবুল কালাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। সেই যুগটি ছিল সুন্দর। কালাম ভাই তখন অসাধারণ সাড়া জাগানো লেখক। শাহের বানু লিখে অনেক নাম করেছেন। দেখতেও অনেক সুন্দর ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির সভাপতি ছিলেন।অনেক নাম ডাক তাঁর তখন।এদেশে এসে কালাম ভাই আর বিজনের বিয়ে হল। একটা বাচ্চা ক্যামেলিয়া হল। এরপরে সে মোস্তফার সাথে চলে গেল। এত ভাল অভিনয়ও কবিতা আবৃত্তি করতো সে কিন্তু মোস্তফার বাড়িতে গিয়ে সে সব ছেড়ে দেয় এবং একেবারে অন্তপুরে ঢুকে পড়ে। এরপর বিজু মানুষের সাথে দেখা করাও বন্ধ করে দেয়। নূরজাহান খালা এবং আমাদের মামী লেডি ব্রাবোন কলেজ থেকেই বি এ পাশ করেছেন। এইখানে লেখাপড়া কালীন সময়েই শামসুদদীন আবুল কালামের সাথে ওনাদের পরিচয় হয়। নূরজাহান খালার সাথে আন্তরিক পরিবেশে অনেক গল্প শেষে চলে এলাম কিন্তু শিশু সওগাতে মামার লেখার কোনো হদিস করতে পারলাম না। আর শিশু সওগাতের কোনো হদিস করতে পারিনি। তবে তিনি কথা দিয়েছিলেন স্টোর থেকে বের করে দেবেন। তার কন্যাও অন্যান্য লোকের সহযোগিতা লাগবে। এরপরে আরো দুতিন দিন গিয়েছিলাম কিন্তু যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম তা পূরণ হয়নি। তবে যে বিশাল একটি সময়ের একটি বর্ণনা পেয়েছিলাম তা জেনে খুব ভাল লেগেছিল। তখনকার সময়ের লেখক রাজনীতিক সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মানুষেরা একজন আর একজনকে খুব ঘনিষ্টভাবে জানতেন।

বেগম পত্রিকার নূরজাহান বেগম ছিলেন নারীদের সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণের একটি মাধ্যম, যার মধ্য দিয়ে নারীরা নিজেদের মানস অস্তিত্বের একটি ভিত্তি দেখতে পেত তার গুরুত্ব কম নয়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ ঢাকা।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত