আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস যেন বিলুপ্ত হয়
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০১৬, ১৭:২১
প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন তার জীবনে কোনো না কোনো সময়ে শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে দুজন স্বামী/অন্তরঙ্গ বন্ধু (বিপরীত লিঙ্গের)/পরিবারের সদস্যদের দ্বারা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। নির্যাতনের শিকার এসব নারীর মাত্র ৪০% কারো না কারো সাহায্য চেয়ে থাকে এবং এদের মাত্র ১০% আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সাহায্যের আবেদন করে।
পৃথিবীর মাত্র ৮৯টি দেশ নারী নির্যাতনের তথ্য জাতীয়ভাবে সংগ্রহ করে থাকে। ১১৯টি দেশে নারী নির্যাতনবিরোধী আইন আছে, ১২৫টি দেশে যৌন সহিংসতাবিরোধী আইন আছে, এবং মাত্র ২৫টি দেশে বিবাহভুক্ত ধর্ষণবিরোধী আইন আছে।
এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বিবিসি ও ইউএনএফপিএ প্রদত্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিবাহিত নারীদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ গৃহ (পারিবারিক) সহিংসতার শিকার, ওই নারীদের ৭৭ শতাংশ প্রতিনিয়ত প্রহৃত হয়, এদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ নির্যাতিত নারীর চিকিৎসা প্রয়োজন হয়, এক-তৃতীয়াংশ নারী স্বামী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। নির্যাতিতদের ৫০ শতাংশ নারী ১৪ বছরের আগেই ধর্ষণের শিকার হয়। এসিড নিক্ষেপ, আগুন দেওয়া, সমাজচ্যুত করা, জোরপূর্বক তালাক– এগুলোর হিসাব রাখা দুষ্কর।
বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে একটা জরিপ চালায়– ‘ভায়োলেন্স এগেইনষ্ট উইমেন সার্ভে’– এতে উঠে এসেছে আরও ভয়ঙ্কর সব তথ্য। আমরা মনে করতাম নারী গৃহে নিরাপদ। এ জরিপের তথ্যমতে, নারী ঘরে আরও বেশি অনিরাপদ, ঘরের ভেতরে স্বামী এবং অন্যান্য আপনজনদের কাছেই নারী অনেক বেশি নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে থাকে এবং নির্যাতনের শিকারও হয়। জরিপে ৭ শতাংশ নারী জানিয়েছে, নির্যাতনের কারণে তারা আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৫ সালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ৫% বেড়েছে, ধর্ষণের ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়েছে (৩৫%), যৌতুকের কারণে নির্যাতন বেড়েছে ২৮%, যৌন হয়রানী বৃদ্ধি পেয়েছে ২৪%। শুধু ২০১৫ সালেই ১,৮৪৭ জন নারী-শিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং সহিংসতার শিকার হয়ে ৩০২ জন নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
সংবাদপত্রে গড়ে প্রতিদিন ১৫ জন বা তার বেশি নারী ও শিশু নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালে প্রকাশিত সহিংসতার শুধুমাত্র এক-তৃতীয়াংশ নির্যাতনের ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে।
এই পৃথিবী কি আমার-আপনার?
আমার এক বন্ধু, উচ্চশিক্ষিতা, পেশায় সফল, বুদ্ধিমতি… অনেক দিন বিষণ্ণ দেখে প্রশ্ন করায় সে জানাল তাঁর মানসিক আর শারীরিক নির্যাতনের ইতিবৃত্ত। বললাম, “আইনের আশ্রয় নাও।”
ভয়ে কুঁকড়ে গেল, বলল, “সুখী চেহারাটা খসে পড়বে সেটাই তো সবচেয়ে বড় ভয়।”
আমার বুয়া, হাতে মুখে কালশিটে, জিজ্ঞেস করতে বলল, “আইন তো গরীবের জন্য না আপা।”
এক মা, নির্যাতন থেকে ১৪ বছরের মেয়েকে বাঁচাতে এক প্রতিবন্ধী পুরুষের কাছে বিয়ে দিয়েছে। আমার এক উচ্চশিক্ষিতা বন্ধু জানিয়েছে, দিনের পর দিন সে হাতে ব্যান্ডেজ, মুখে কালশিটে নিয়ে অফিস করেছে, কেউ জানতেই পারেনি তার গৃহে নির্যাতিত হওয়ার কথা।
এবার আসা যাক একটি প্রাসঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। সরকার নিজেকে নারীবান্ধব, শিশুবান্ধব বলে দাবি করে, সেই সরকার কেমন করে ‘যদি’ ‘কিন্তু’ ‘বিশেষ অবস্থায়’ ‘শর্ত সাপেক্ষে’ বাল্য বিয়েকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে? এতে দেশের কী লাভ? এতে কোন ভালোটা বয়ে আসবে, উন্নতির কোন সোপানে আমরা পা দিতে পারব? তবে কেন এই তোড়জোড়? এতে কে লাভবান হবে? এতে অর্থনৈতিক কি উন্নতি সাধিত হবে? সরকার কি সচেতন, কোনো পাঁকেচক্রে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টা নয়তো এটি?
বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ থেকে স্বপ্ন দেখা এই দেশের নারী সমাজ মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে দেওয়ার এই ধারাবাহিক চক্রান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
গ্রামে-গঞ্জে-মফস্বলে নারীর নিরাপত্তা কতটা হুমকির মুখে তা তো তনুরা জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে। দেশের মান রাখতে রাষ্ট্রদূতের ব্যাগ খুঁজে পেতে যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগে মাত্র ২৪ ঘণ্টা, তবে তনুর খুনিকে পেতে এই বাহিনী কেন বছর পার করে দিচ্ছে? কাকে বাঁচাতে দেশের মান ডুবাচ্ছে, সরকারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করছে?
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আকুল আবেদন, আপনি আপনার এমপিদের দায়বদ্ধ করুন, আপনার সব জনপ্রতিনিধিদের দায়বদ্ধ করুন, আপনার প্রশাসনকে দায়বদ্ধ করুন, আপনার পুলিশ বাহিনীকে দায়বদ্ধ করুন… আপনি কেন বলছেন না, যে এলাকায় একটা নারী নির্যাতনের খবর আসবে, একটা মেয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে উত্ত্যক্তের শিকার হবে, সেই এলাকার সব কর্তাব্যক্তিকে আপনার কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, নারী নির্যাতনের ব্যাপারে আপনার ‘জিরো টলারেন্স’-এর কথা সবাইকে জানিয়ে দিন। আপনি দু-একটা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিন… আমাদের বিশ্বাস আমরা ইতিবাচক ফল পাব।
উন্নয়নের মহাসড়কে আগুয়ান বাংলাদেশের অর্থনৈতিতে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। ভুলে গেলে চলবে না, নারী ভোটও কিন্তু অর্ধেক ভোট। নারীবান্ধব সমাজ অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবে। পিতার সম্পত্তির কিয়দংশ পেয়ে না-পেয়ে, স্বামীর হাতে প্রতিনিয়ত প্রহৃত হয়ে, রাস্তায়, বাজারে, কর্মক্ষেত্রে, বিদ্যালয়ে নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করেও নারী অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে।
নারীকে নিরাপদ পৃথিবী দাও, নারী তোমাদের দেবে ততোধিক বাসযোগ্য এক সমাজের নিশ্চয়তা।
নারী, তুমি নীরবতা ভাঙ… ভাঙতেই হবে।
আজ ২৫ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। এ দিবস যেন পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়…