‘চরিত্রহীন’ গালিটা কেন আমার গায়েই এসে লাগল?
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৪:৫০
একটি টক-শো তে একজন নারী সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একজন পুরুষ রাজনীতিবিদ তাকে ‘চরিত্রহীন’ বলে গালি দিয়েছেন। যদি নারীটির প্রশ্ন রাজনৈতিক আক্রমণ হয়ে থাকে, জবাবে পালটা রাজনৈতিক আক্রমণ করা যেতে পারত। যদি তার প্রশ্ন উস্কানিমূলক হয়ে থাকে তাহলে সভ্য ভাষায় উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানানো যেতে পারত। কিন্তু তার কোনোটাই না করে তিনি বললেন ‘আমি আপনাকে চরিত্রহীন বলতে চাই’। এখানে অনেকগুলো অপরাধ ঘটেছে- ব্যক্তিগত আক্রমণ, অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা, অশোভন ভাষার প্রয়োগ এবং নারীর অবমাননা কারণ হলফ করে বলা যায় প্রশ্নকারী একজন পুরুষ হলে তিনি ‘চরিত্রহীন’ গালিটা ব্যবহার করতেন না।
এই রাজনীতিবিদের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। সাংবাদিক নারীটির সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় থাকলেও আমি তার ‘ফ্যান’ নই বরং চাক্ষুস তর্ক-বিতর্কে নিজের মত প্রকাশে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটতে হয়েছে আমাকে। এদের কারো প্রতিই আমার কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ/অপছন্দ নেই। আমি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের চামচাও নই, কাজেই এদের কারো প্রতি আমার গভীর রাজনৈতিক সমর্থনও নেই। তারপরও এই ‘চরিত্রহীন’ গালিটা কেন আমার গায়েই এসে লাগল? সেই ব্যাখ্যাই দিচ্ছি।
এই লেখাটা যারা পড়ছেন, তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়েই রয়েছেন। আপনাদেরকে অনুরোধ করব- কমেন্টে সততার সাথে লিখুন জীবনে কতবার আপনাকে ‘চরিত্রহীন/দুশ্চরিত্র’ গালিটা দেয়া হয়েছে এবং কে দিয়েছে?
আমি জীবনে অসংখ্যবার সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে এই গালির শিকার হয়েছি। যখন আমার প্রথম ‘স্বামী’কে তালাক দেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন বারবার আমাকে শুনতে হয়েছে আমার চরিত্র খারাপ, অন্য পুরুষের প্রতি আগ্রহ থেকেই আমি এই কাজটা করতে চাচ্ছি। আমি যখন তালাক রেজিস্ট্রি করতে যাচ্ছিলাম তখনও আমাকে শুনতে হয়েছে ‘ভালো মেয়েরা এমন সাজুগুজু করে তালাক দিতে যায় না’। তালাক হয়ে যাওয়ার পর ইনবক্স মেসেজে আমাকে ‘বেশ্যা’ বলে গালি দেয়া হয়েছে, আমার মেয়েকেও ‘বেশ্যা’ বানানোর চেষ্টা করছি বলে দাবি করা হয়েছে কারণ সে পশ্চিমা পোষাক পরে। দেশে শুধুমাত্র পথে নিজে গাড়ি চালানোর জন্যও আমাকে ‘মাগী’ ডাকা হয়েছে। লেখালেখিতে নারীর সমস্যার কথা তুলে ধরার জন্য আমাকে চরিত্রহীন ডাকা হয়েছে। ধর্মীয় বা সামাজিক রীতিনীতির কারণে পিতার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলায় আমাকে চরিত্রহীন ডাকা হয়েছে।
যেসব বিষয়ে আমাকে বারবার চরিত্রহীন ডাকা হয়েছে তার কোনোকিছুর সাথেই চরিত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। কাজেই যখনই কোনো নারীকে ‘চরিত্রহীন’ ডাকা হবে, সেই গালিটা আমার গায়েই এসে লাগবে।
পুরুষ ঠকামো করলে সে ঠক, মিথ্যা কথা বললে মিথ্যাবাদী, ভণ্ডামি করলে ভণ্ড, কিন্তু নারী যা-ই করুক না কেন সে ‘চরিত্রহীন’। সে প্রতিবাদ করলে চরিত্রহীন, প্রশ্ন করলে চরিত্রহীন, নিজের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হলে চরিত্রহীন। নারীকে বিচারের অন্য কোনো মানদণ্ড বানায়নি সমাজ। পুরষের জন্য ‘দুশ্চরিত্র’ গালিটা তেমন একটা ব্যাপার নয় কিন্তু নারীর জন্য ‘চরিত্রহীন’ গালিটা মোক্ষম কারণ নারীর চরিত্রসুদ্ধিকে একটা ট্যাবু বানিয়ে রাখা হয়েছে। পুরুষ ভাবে এই গালিটা দিতে পারলেই একজন নারীকে ঘায়েল করা যাবে সবচেয়ে বেশি তাই নারীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকে এমন একটা গালি দেয়ার কথা ভাবেন একজন উচ্চশিক্ষিত পুরুষও।
আমি নিজের চরিত্রের কাঁথা নিজের হাতেই পুড়িয়ে রেখেছি। এই গালিটা আমার গায়ে হয়ত লাগে কিন্তু ফুলের টোকার মতই আলতোভাবে। আমার দৃষ্টিতে এটা কোনো গালিই না, কারণ যখন এই গালিটা দেয়া হচ্ছে তখনই গালিদাতার অক্ষমতা এবং অসহায়ত্ব স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার কিছু বলার নেই বলেই তিনি সেই বহু ব্যবহারে ভোঁতা হয়ে যাওয়া পুরোনো হাতিয়ারটি ব্যবহার করছেন।
তাহলে কেন এই প্রতিবাদ? প্রতিবাদ গালিটার বিরুদ্ধে নয়, বরং এর পেছনে লুকিয়ে থাকা সুপ্রতিষ্ঠিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে। এই ক্ষেত্রে পুরুষ রাজনীতিবিদটি নিজেই নিজেকে পরাজিত এবং অপমানিত করেছেন। গালিটা দেয়ার পরও নারীটি হাসছিলেন, সাবলীলভাবে কথা বলে যাচ্ছিলেন কিন্তু পুরুষটি সঠিক শব্দমালা খুঁজতে গিয়ে বাক্যের গঠনে বিভ্রাট ঘটাচ্ছিলেন বারবার।
জানা গেছে প্রকাশ্যে দেয়া একটা গালির জন্য তিনি গোপনে ক্ষমাও চেয়েছেন। আমি গোপনে সংঘটিত অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে ঘটা করে ক্ষমা চাওয়ায় বিশ্বাসী একজন মানুষ। আর কী বলব?
লেখক: শিক্ষক, অনুবাদক ও নাট্যকর্মী