সোজা হয়ে দাঁড়াতে মেরুদণ্ড না, সৎসাহস লাগে
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:১৭
কলেজে যাওয়ার পথে গত চারবছর ধরে একটা শারীরিক প্রতিবন্ধী লোককে দেখছি। তার আর আমার ঘড়ি যেন এক লয়ে বাঁধা। কলেজের পাশের ট্রাফিক লাইটটা প্রতিদিন একই সময়ে একই নিয়মে লাল হয়ে যায়। আমি থামি, ঠিক তখনই লোকটা পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। হেঁটে যায় বললে ভুল হবে, বলতে গেলে গড়িয়ে গড়িয়ে যায়। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ পুরোটাই বাঁকা, মাথা নুয়ে প্রায় পেটের কাছে এসে লেগেছে। পায়েও কিছু একটা সমস্যা, হাঁটে কচ্ছপের গতিতে। তার নুয়ে পড়া পিঠে হালকা একটা ব্যাগ লাগানো, বুঝতে কষ্ট হয় না সে কর্মক্ষেত্রে চলেছে। অনেক সময় ট্রাফিক লাইট সবুজ হয়ে গেলে আমি গাড়ি নিয়ে সাঁ করে ছুটে যাই, ফিরে তাকাই- সে নিজের দেহের সাথে যুদ্ধ করে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। নিজের গতি এবং তার শক্তি ও অধ্যাবসায় আমাকে লজ্জা দেয়।
আমাদের কলেজে একটা ছেলে আছে, হুইল চেয়ারে বসে ক্লাস করতে আসে। তার দু'টো পা সুতার মতন চিকন হয়ে ঝুলে থাকে, পিঠটা বাঁকা, সম্ভবত মেরুদন্ডতে গুরুতর কোনো সমস্যা। এই ছেলেটা সরাসরি আমার ছাত্র নয়, তবে একদিন শিক্ষক ঘাটতির কারণে দুটো ক্লাস যুক্ত করা হয়েছিল বলে তাকে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। মাথা সোজা করে তাকাতে পারে না কিন্তু কী সীমাহীন মনোযোগ, শেখার ইচ্ছা, অসাধারণ রসবোধ আর বুদ্ধিমত্তা!
গতবছর এক বৃষ্টি ভেজা দিনে গাড়ি পার্ক করে রাস্তা পার হচ্ছি। দেখি এক অন্ধ লোক রাস্তার মাঝখানে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদেশে রাস্তাঘাটে অনেক অন্ধলোকই একা একা বলিষ্ঠতার সাথে চলাফেরা করে- কারো সাথে গাইড ডগ থাকে, কারো বা শুধুই লাঠি ভরসা। এই লোকটার মনে হলো সেই অভ্যস্ততা নেই, নিশ্চয়ই এদেশে নতুন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'তোমাকে সাহায্য করতে পারি?' সে ইংরেজি ভালো বলতে পারে না। আমার হাতে একটা কাগজ তুলে দিল, পড়ে দেখি সে আমার কলেজের নতুন ছাত্র। এই ছাত্রটা প্রায় ছয়মাস আমাদের কলেজে ছিল। এই ছয়মাসে তাকে অনেক চটপটে হয়ে উঠতে দেখেছি।
আসলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে মেরুদণ্ডও লাগে না, মনোবল এবং সৎসাহসই যথেষ্ট। দেখতে হলেও চোখ লাগে না, মন থাকলেই হয়।
জেসমিন চৌধুরীর ফেসবুক থেকে