যেভাবে লড়েছি
প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০১৮, ০০:৪৫
আমার শিক্ষার্জনের লড়াইয়ের গল্পের প্রথম দু'টো খন্ড যারা পড়েছেন তারা জানেন অনেক কষ্ট করে কোলে একটা, পেটে একটা বাচ্চা নিয়ে দুই মহাদেশে নিরন্তর ছোটাছুটির পর অনেক টাকা খরচ করে এইচএসসি পাশ করেছিলাম। নিরাশাবাদীদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে মানবিক বিভাগ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনও পেয়েছিলাম।
সাফল্যের স্বাদ যেমন মিষ্টি তেমনই নেশা জাগানিয়া। এরপর আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বই রইলো না, স্থির করে ফেললাম ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স করব এবং আমাদের সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজেই পড়ব যেখানে আমার ভাইবোনদের সাথে ছোটবেলা বহুবার গিয়েছি।
তখনো আমার প্রথম স্বামীর সাথেই সংসার করি, তাকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। তারও অনেকদিনের শখ ছিল সিলেটে থাকবেন, ব্যবসা করবেন কাজেই কোনো মতান্তর ছাড়াই ইউকে'র পাট চুকিয়ে চিরতরে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। চাকরি ছেড়ে, বাসা ভাড়া দিয়ে, ব্যাংক থেকে কিছু টাকা কর্জ নিয়ে দেশে চলে গেলাম। কিন্তু সমস্ত ব্যবস্থা করতে প্রায় তিনবছর লেগে গেল।
দেশে ফিরে এমসি কলেজের কার্যালয়ে গিয়ে বুঝলাম এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আরো অনেক খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়োজন ছিল। আমি কল্পনাও করতে পারিনি পড়াশোনা করবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং বুদ্ধিগত যোগ্যতা থাকলে অন্য কোনো বাধা আসতে পারে। কেরানী মশাই কোনো ধরনের আন্তরিকতা বা দুঃখপ্রকাশ ছাড়াই জানিয়ে দিলেন আমার অনার্স পড়বার স্বপ্ন মেঘের উপর ঘর বানানোর মতই অসম্ভব। আমার স্টাডি-ব্রেক অনেক লম্বা, কাজেই আমাকে ভর্তি করা যাবে না।
আরো খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম প্রাইভেটেও অনার্স পড়া যাবে না। আমার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বুঝি আর সফল হলো না। আমি একেবারেই মুষড়ে পড়লাম। আমার চাচাতো বোনের হাজব্যান্ড মিফতাউর রহমান তখন সিলেট মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল। তিনি বললেন, 'এতো তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিও না। বিএ পাস কোর্স করে ফেলো, তারপর প্রিলিমিনারি করে ইংরেজিতে মাস্টার্স করতে পারবে।'
উনার পরামর্শ মত বিভিন্ন কলেজে পাসকোর্সে ভর্তি হবার জন্য ধর্ণা দিতে লাগলাম। লাভ হলো না। সেই একই কাহিনী- স্টাডিব্রেক বেশি লম্বা হয়ে গেছে, আমাকে ভর্তি করা যাবে না। অবশেষে আমার বড়বোন বললেন একটা অখ্যাত মহিলা কলেজের নাম (সংগত কারণে নাম উল্লেখ করছি না) যে কলেজ থেকে আজ পর্যন্ত কেউ বিএ পাশ করেনি। তারা হয়তো সহজেই ভর্তি করে নেবে আমাকে।
নতুন আশায় বুক বেঁধে সিলেট শহর থেকে বেশ দূরে অবস্থিত সেই অখ্যাত কলেজের কেরানীর শরণাপন্ন হলাম। তিনিও আমাকে অম্লানবদনে 'না' বলে দিলেন। আমি বললাম,
'আপনাদের প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলতে চাই'।
'লাভ হবে না, আমরা নিয়ম ভাঙবো না'।
অনেকটা জোর করেই প্রিন্সিপালের কামরায় ঢুকে গেলাম,
'স্যার আপনার সাথে একটু কথা বলব'।
'অনুমতি ছাড়া ঢুকলে কেন?'
'কেউ অনুমতি দিচ্ছিল না'।
'বলো, কী চাও।'
আমার আবেদন শুনে তিনিও না বলে দিলেন। আমি বললাম,
'শুনেছি আপনাদের কলেজ থেকে কেউ এখনো বিএ পাশ করতে পারেনি। আমি একটা ফার্স্টক্লাস এনে দিতাম'।
'তুমি তো খুব অহংকারী মেয়ে!'
'অহংকারী না স্যার, আত্মবিশ্বাসী এবং ডেসপারেট।'
চমক একটা চমৎকার বিষয়, সবসময় কাজে দেয়। এবারও দিলো, আমার কথাবার্তায় চমকে গিয়ে প্রিন্সিপাল আমাকে ভর্তি করার অনুমতি দিলেন।
ততদিনে আমার প্রথম স্বামীর সাথে বিচ্ছদের প্রথম পর্ব শুরু হয়ে গেছে। আম্বরখানার একটা নির্মানাধীন বিল্ডিং এর রেলিংবিহীন সিঁড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে দুই বাচ্চা নিয়ে একা থাকি। আনন্দনিকেতন স্কুলে ফুলটাইম শিক্ষকতা করি, সেই রোজগারে সংসার চলে না বলে বাসায় একটা কোচিং সেন্টারের মত খুলেছি, দশটার মত বাচ্চাকে পড়াই। কাজের চাপে দমবন্ধ অবস্থা, কাজেই কলেজে চেহারা দেখাতে পারি না একেবারেই। শুনেছি পড়ানোর মানও তেমন ভালো না, কাজেই বাসায় একা একাই পড়াশোনা করি।
পড়তে যে এতো আনন্দ তা সে-ই বুঝবে যাকে পড়াশোনার অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়। আমি টিভি দেখি না, বেড়াতে যাই না। পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ নিয়ে যুক্তিবিদ্যা আর ইসলামের ইতিহাস পড়ি। রান্নাঘরের দেয়ালে সেলোটেইপ দিয়ে নোটের পাতা আটকে রাখি, রান্না করতে করতে পড়ি। স্কুলে যাওয়া আসার পথে রিক্সায় বসে পড়ি, বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেলে রাত জেগে পড়ি। শাওয়ারে ঢুকলে দরজার বাইরে নোটের পাতা রেখে দেই, গায়ে সাবান মাখার আগে পরে উঁকি দিয়ে পড়ি।
দেখতে দেখতে পরীক্ষার সময় এসে গেলো। এডমিট কার্ড আনতে গিয়ে অনেক ঝক্কি পোহাতে হলো, দীর্ঘ অনুপস্থিতির জন্য জরিমানাও হলো। একজন শিক্ষক বললেন, 'তোমাদের মত অলস ছাত্রীদের জন্যই কলেজের এতো দুর্নাম। সারাবছর গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে, আর পরীক্ষার সময় এসে হাজির হবে। এজন্যই তো পাশ করতে পারো না।' স্যারের কথা শুনে কষ্ট লাগল। তিনি যদি জানতেন কী কঠোর পরিশ্রম করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছি! কিন্তু কিছু বললাম না, যদি পারি ফলাফল দিয়েই দেখিয়ে দেব।
স্কুল থেকে একটানা ছুটি পাওয়া গেল না, শুধু পরীক্ষার দিনগুলোতে ছুটি। সবাই বলল, বি এ পাসকোর্স থেকে পাশ করাই কঠিন, আমি কি পারবো? আমি মন প্রাণ ঢেলে দিয়ে পড়তে থাকলাম। পরীক্ষার আগের রাতে ভোর চারটা পর্যন্ত পড়তাম, দু'ঘন্টা ঘুমিয়ে আবার ছয়টায় উঠে পড়তে বসতাম। সারাদিন ক্লান্তি অথবা ঘুমের বিন্দুমাত্র ছায়াও আমাকে স্পর্শ করতো না। মনে হতো পৃথিবীর সমস্ত শক্তি এসে আমাতে ভর করেছে। আমার আহার নিদ্রা লাগে না, আলো বাতাসই যথেষ্ট।
কয়েকমাস পর এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন। ছেলেমেয়েকে নিয়ে ফলাফল আনতে গেলাম। কেরানী বলল আমার ফলাফল দিতে পারবে না, প্রিন্সিপাল বলেছেন আমাকে তার কামরায় যেতে। পরীক্ষা খুব একটা খারাপ হয়নি তবু বুক কাঁপছিল।
স্যার আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন, হেসে অভিনন্দন জানালেন। বললেন, 'আজ পর্যন্ত আমার সাথে তোমার মত এতো উদ্ধত ভাষায় কেউ কথা বলেনি, কেউ এভাবে নিজের কথাকে সত্যও প্রমাণ করতে পারেনি। তুমি একজন লৌহমানবী। পড়াশোনা বাদ দিও না।'
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এ ও কি সম্ভব? আমি সত্যিই ফার্স্টক্লাস পেয়েছি? একা একা পড়ে? শাওয়ার করতে করতে, রান্না করতে করতে পড়ে? সন্তানের সাফল্যে যেমন মা-বাবা গর্বিত হোন, তেমনি গর্বে আমার দুই বাচ্চার বুক ফুলে উঠলো। ছোটটার বয়স তখন পাঁচ।
আমরা রিক্সায় বাড়ি ফিরছি। হুড ফেলে দিয়েছি, বাতাসে উড়ছে আমার খোলা চুল। আমার মেয়ে বারবার মুখ বাড়িয়ে আমার গালে চুমা খাচ্ছে। ছেলে হাতটা ধরে আছে। চোখের জলে আমার গাল ভেসে যাচ্ছে, দুই হাতে মুছে নিয়ে আবার খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ছি, যোগ দিচ্ছে আমার দুই বাচ্চাও। পথচারীরা, অন্যান্য রিক্সার প্যাসেঞ্জাররা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি একজনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, 'আমরা পাগল না। আমি ফার্স্টক্লাস পেয়েছি, তাই এতো খুশি।'
আমার বাচ্চারা হেসে ফেলল, 'মা আমরা পাগল না, কিন্তু তুমি পাগল।'
সাতসমুদ্রের নিচ থেকে আমাকে হাজারো মণিমুক্তা এনে দিতে পারো, সেদিনের থেকে বেশি তৃপ্তি কখনোই দিতে পারবে না।
জেসমিন চৌধুরীর ফেসবুক থেকে