দিন শেষে লড়াইটাই চিরন্তন এবং ধ্রুব
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০১৭, ২০:১৪
লড়াইটা চলছিলো বহু বছর ধরে পরিবারের ভেতরেই। আজকে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির মতো একটা পারিবারিক আবহে ভীষণ অসম এক রাজনৈতিক-সামজিক লড়াই শুরু করতে হয়েছে। পাওয়ার পলিটিক্স এর লড়াইয়ে একদিকে পুরো পুরুষতন্ত্র আর একদিকে আমি একা একজন মেয়ে। হাঁটু পর্যন্ত চোরাবালিতে পা ডুবিয়ে রেখেই এই যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়েছি আজ একলা আমি। জানি ডুবে যেতে পারি, নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারি। পুরুষতন্ত্রের সমস্ত সুবিধা নিয়ে প্রতিপক্ষ মরণকামড় দিবে এটা মাথায় রেখেই লড়াইয়ের মাঠে নেমেছি। নেমেই বুঝেছি, একটা পরিবারের সব আস্ত মস্ত পুরুষেরা তাদের টাকা, প্রভাব, অভিজ্ঞতা সব নিয়ে একাট্টা হয়েছে একজন মেয়েকে মোকাবেলা করার জন্য। বিশাল ‘হেডম’ দেখানো পুরুষরা তাই বেছে নিয়েছে বহুল ব্যবহৃত সেই পুরোনো শর্টকাট অস্ত্র ‘চরিত্রহরণ’। তাদের টাইমলাইন ভেসে যাচ্ছে আমার ব্যক্তিচরিত্রের পোস্টমর্টেম করে। এখানেই নৈতিক পরাজয় হয়ে গেছে ওদের, আদর্শ তাই এখানে অবান্তর।
এমন অসম একটি লড়াইয়ে যারা আমাকে মহা মানবের মতো আচরণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন, ক্ষমা করে দেয়ার অনুরোধ করছেন, তাদের শুভকামনা এবং পরামর্শ মাথায় নিয়েই বলছি, আমি মানুষ, রক্তমাংসের মানুষ এবং ভীষণভাবেই মানুষ। তাই আমার আবেগ, অনুভূতি, রাগ, ক্রোধ সব কিছুর প্রকাশ থাকে। আমি ‘জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি’ হাসতে পারি না। সে দায় আমি কখনো নিইনি। আমি আগুনে পুড়লে, পোড়াইও। কেউ আমাকে ঢিল ছুঁড়লে পাটকেলটা হিসেব মতো ছুঁড়ে দিতে দু’বার ভাবি না। আমার নারীত্বকে দুর্বলতা ভেবে নিয়ে আমার বাবা মাকে কিংবা নিজেকে অসম্মান করার সুযোগ কাউকে বিনা হিসেবে ছেড়ে দিলে নিজেকেই ক্ষমা করতে পারি না আমি। এটা আমার নিজের প্রতি নিজের কমিটমেন্ট।
আজকের এই জীবনটা আজ এখানে গড়ে নিয়ে আসার পেছনে আমার প্রচ্ছন্ন একটা গর্ব আছে। জীবনের একটা একটা ইট যখন গাঁথছিলাম আমার শ্রমে ঘামে, তখন কোথাও কখনো, এক মুহুর্তের জন্যও এই পরিবারের কারো নাম কিংবা কারো আত্মীয়তার পরিচয় ব্যবহার করতে হয়নি আমাকে। বরঞ্চ সুযোগ পেলেই তারা আমার পথে সযত্নে কাঁটা ছড়িয়ে রেখেছে আর আমি ফুল ভেবে সে কাঁটা মাড়িয়ে পথ হেঁটেছি মাথা উঁচু করেই। করুণাময়ের কি অপার দয়া! যারা সারাজীবন আমার পথে কাঁটা বিছিয়ে আমাকে রক্তাক্ত করেছে, আমি মেয়ে বলে আমার বাবাকে ঘৃণা করেছে, তাদের প্রত্যেকের বিপদে, চিকিৎসার প্রয়োজনে, কন্যদায়গ্রস্থ সংকটে, অর্থকষ্টে পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ তিনি আমাকে দিয়েছেন।
আমার লজ্জা, আমি এমন একটি পরিবারে জন্মেছি, যেখানে আমার রোজগারকে হারাম মনে করা হয়। কারণ আমি মেয়ে, আমি এনজিওতে কাজ করি, আমি দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াই। আমার বাবার সাথে কোরবানির ঈদ করি বলে আমার কোরবানী জায়েজ হবে না বলে ফতোয়া দেয় আমার আপন চাচা। আমার টাকায় হজ করলে হজ কবুল হবে না বলে আমার বাবা মাকে বিভ্রান্ত করে এই ধর্মজীবিরা। আজকে যখন ওরা আমার রোজগারকে হারাম বলে তখন আমার ভীষণভাবে মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, এই আমার হারাম রোজগারের বাড়িতে থেকে, খেয়ে কি অবলীলায় এই মানুষগুলো নিজেদের বিপদ উদ্ধার করেছে, নিজেদের শিক্ষাজীবন, পেশা সব গুছিয়ে নিয়েছে!
আজকে আমার রোজগারকে হারাম বলে, আমাকে নষ্টা বলে টাইমলাইনে পোস্ট দেয়, সে যে বিছানায় ঘুমায় সেটাও এই নষ্টা (?) মেয়ের হারামের টাকায় দেয়া যৌতুক। আমার খারাপ লাগে না যখন আমারই আত্মীয় আজকে আমাকে খোলা টাইমলাইনে নষ্টা বলে আর অন্যরা তালি বাজায়। কারণ আমি জানি এ-ই সেই লোক যে একদিন স্বার্থের জন্য এই নষ্টা মেয়েকে 'মা' বলে ডাকতো, পা জড়িয়ে ধরেছিলো। এরা সেই আত্মীয়রা যারা নিজেদের প্রয়োজনে এই খারাপ মেয়ের অস্থি মাংস চুষে খেয়ে নিজেদের পুষ্ট করেছে বছরের পর বছর ধরে। শুধু এই গ্লানি আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু যে, আমি বেঈমানের বংশধর। পরমেশ্বরের কাছে তবু আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই এজন্য যে, আমাকে এই বেঈমানদের মুখাপেক্ষি হতে হয়নি কখনো।
আমার সবচেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্য হলো আমি এমন এক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেছি, যে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই ভয়ঙ্কর নারীবিদ্বেষি, সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় সহিংসতা উস্কানি দেয়। এরকম একটি পরিবারে আমার মতো ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে চলা মেয়েদের কতটুকু কলঙ্কিত হতে হয়, কি পরিমাণ কটুক্তি সয়ে যেতে হয়, কি পরিমাণ নিন্দিত হতে হয় সে অভিজ্ঞতা মনে হয় না কাউকে লিখে বোঝাতে হবে। তবুও একদিন লিখবো হয়তো। আমার লজ্জা হয়, আমাকে এমন একটা সমাজকে রিকগনাইজ করতে হয়, যে সমাজ আমাকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করেছে স্বামী সন্তানের সেবা (?) না করে দেশে বিদেশে টাকার জন্য ঘুরে (?) বেড়িয়েছি বলে। আমার নিজের রক্তের প্রতি ধিক্কার আসে যখন দেখি শুধু আমাকে সহযোগিতা করে বলে, সংসারের কাজ করে বলে এই আমার আত্মীয়রাই (?) আমার স্বামীকে আমার সামনে রামছাগল ডেকেছে, স্ত্রৈণ বলেছে। এই এরাই আবার এই স্ত্রৈণ (?) পুরুষের ভালোমানুষিকে ব্যবহার করেছে নিজেদের ভোগে।
আমার ভীষণ লজ্জা হয় এটা ভাবতে যে আমার পরিবারের সদস্যরা সাঈদী মুক্তি পরিষদ গঠন করে, রাজাকারের গায়েবানা জানাযা পড়ে, আস্তিক নাস্তিকের বিভাজনে ফেলে মানুষ মারার জন্য চাপাতি শান দেয়। আমার ভীষণ আত্মগ্লানি হয় এই জন্য যে, এরাই তারা, যারা সাঈদীকে চাঁদে দেখে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে ব্যঙ্গ করে। এই এরাই তারা, যারা শাহাবাগের উত্তাল গণজাগরণকে যৌণজাগরন বলে কলঙ্কিত করে। এরাই আমার বাবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতিকে ব্যবহার করে বছরের পর বছর ধরে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়ে তলে তলে গোলাম আযমের জন্য রাজভোগ পাঠিয়েছে, মুজাহিদির জন্য রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়েছে, আপ্যায়ন করেছে মীর কাশেম আলিকে।
এই দায়গ্রস্থ অস্তিত্বসংকটে পড়া মানুষদের বড়ো ভয় লড়াইয়ের ময়দানে মেয়েদের। তাই ওদের যুদ্ধের কৌশল কেবল ব্যক্তি আক্রমণ আর চরিত্রহননে গিয়ে ঠেকে। তবু লড়াইটা জারি রাখবো, রাখতেই হবে। কি আছে! হয় জিতবো, না হয় শিখবো। এ জীবনে হাতে তুলে কেউ কিছু এনে দিয়ে বলেনি, নাও। যা পেয়েছি লড়াই করেই পেয়েছি। দিন শেষে তাই এই লড়াইটাই চিরন্তন এবং ধ্রুব সত্য বলে জানি। সব ঝড় ঝাপ্টা ঠেলে বছরের পর বছর ধরে এই যে অসম লড়াইগুলো চালিয়ে যাচ্ছি আমরা, এই একলা মেয়েরা, সেইখানেই তো জয় আমাদের।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী সংযোগ বাংলাদেশ