প্রয়োজন বৈষম্যহীন সমাজ
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০১৭, ০৫:০৯
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটি পালনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস। এই দিনটি বিশ্বের নারীমুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন-এর আহ্বানে যে নারী-দিবস পালনের সূচনা হয়েছিল ১৯১০ সালের ৮ মার্চ তা এ বছর তার ১০৭ বছরে পদার্পণ করলো। বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে যথাযোগ্য মর্যাদায়।
প্রতিটি মানুষের জীবনের সংগ্রাম ভিন্ন। আমাদের সমাজে নারীর যুদ্ধটা আবার পুরুষের থেকে ভিন্ন। সমাজ আমাদের বৈষম্যমূলক। এই ভোগবাদী সমাজে নারীদের বৈষ্যমের শিকার হতে হয় দফায় দফায়। আমাদের এই নিপীড়নমূলক সমাজে নারীরা মোটেও দুর্বল নয়। কিন্তু পুঁজিবাদী এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের দুর্বল করে রাখছে।
মানব জীবনে প্রথম শিক্ষার সূচনা হয় পরিবার থেকে যা সারা জীবনের বেড়ে উঠার পরিবেশের উপর প্রভাব বিস্তার করে। পরিবারে শুরুতেই শেখানো হয় নারী-পুরুষের বৈষম্য। পরিবার থেকে শিখছে একজন সন্তান কিভাবে একজন মেয়ে হয়ে উঠতে হয় আর কিভাবে একজন ছেলে হয়ে উঠতে হয়। পরিবারেই নারী প্রতিনিয়ত বুঝতে পারে একটা পুরুষ কীভাবে আধিপত্য বিস্তার করে একজন নারীর মানবিক সত্ত্বায়। তাই প্রয়োজন নারী মুক্তি আন্দোলন। যার সূচনা হতে হবে পরিবার থেকেই।
আর এই পরিবার হলো সমাজেরই একটি অংশ। সমাজ দ্বারা কিন্তু পরিবারের এই বৈষম্য নির্ধারিত হয়। এই পরিবার এবং সমাজের নিয়ম নীতির মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের সামাজিক বৈষম্য শুরু হয় শৈশবকাল থেকে। আমাদের সমাজে মেয়ে এবং ছেলে ভিন্ন ভিন্নভাবে বেড়ে উঠে। মেয়েরা খেলবে ঘরের ভিতরে পুতুল বিয়ে আর ছেলেরা খেলবে বাইরের খোলা মাঠে। পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন আচরণ দেখায়। যার ফলশ্রুতিতে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। আমাদের এই ভোগবাদী তথা পুঁজিবাদি সমাজ ব্যবস্থা এই বৈষম্য তৈরির কারখানা। এই ভোগবাদী কারখানার চাকাতে ঘুরতে ঘুরতে নারীরা প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারছে না।পাশাপাশি একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেই দেশের প্রকৃত মানুষ গড়ার কারখানা। সেই শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রয়েছে বৈষম্যমূলক নিয়ম-রীতি। নারী-পুরুষের শারীরিক ভিন্নতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে আজ সমাজের নারী নিপীড়ন, ধর্ষণ এর মতো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে।
শ্রেণি বিভাজন ও দখলের প্রক্রিয়ায় বিশ্ব আজ পুরুষতন্ত্রের অধীন। আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় শ্রেণি বিভক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে নারীর অধিকার হারানোর প্রক্রিয়াটিরও সূত্রপাত ঘটেছে। আদিম মাতৃতান্ত্রিক বা মাতৃনির্ভর সমাজব্যবস্থা সরিয়ে ক্রমাগত স্থান করে নিয়েছে পুরুষকেন্দ্রিক উৎপাদন-উত্তরাধিকারের সমাজব্যবস্থা এবং এর সাথে পাল্লা দিয়ে নারীরা ততই দুর্বল, অধিকারহীন হয়ে পড়েছে। আজকের বিশ্বে পুরুষ সর্বেসর্বা আর তাই নারী নিঃস্ব। হারাতে হারাতে নারীর হারানোর অবশিষ্ট কিছুই নেই।
অন্যদিকে বাজারমুখী পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের ধাক্কায় সমাজ ব্যবস্থা দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র-বেকারত্ব-ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের শিকার হচ্ছে বহু সংখ্যক মানুষ। অল্প কয়েকজনের কাছে রয়েছে সীমাহীন সম্পদ। ফলে ভোগবাদী সমাজে বৈষম্য বেড়ে গিয়ে পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কগুলো নষ্ট করে ফেলছে। মানুষ তার নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবিকতা হারিয়ে ফেলছে। এই সংকট পারিবারিক জীবনেও দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিরোধ-অশান্তি সৃষ্টি করছে। বিশ্বায়নের ফলে বর্তমানে অতি ভোগবাদ, অপসংস্কৃতি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, ব্যক্তিস্বার্থ সর্বস্বতাকে সঞ্চারিত করছে এবং তা নারী নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণের মতো বিষয়কে ইন্ধন জোগাচ্ছে। বিশ্বায়ন সূচিত অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সৃষ্ট কর্মচ্যুতি, বেকারত্বের ফলে পুরুষরা ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে ভীত ও হিংস্র হয়ে উঠছে। আর এর খেসরাত দিতে হচ্ছে নারীদের।
পারিবারিক নির্যাতনের মূল কারণ হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। যা পুরুষকে স্বাবলম্বী, ক্ষমতাবান, নিয়ন্ত্রক, কর্তৃত্বপরায়ন, একক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী করে তোলে। আর নারীরা এই ব্যবস্থার কবলে পড়ে হয়ে উঠে পরনির্ভরশীল, ক্ষমতাহীন, অসহায় ও অধিকার বঞ্চিত। নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মূলত সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই লড়াই পুঁজিবাদকেও আঘাত করে। তাই নারী মুক্তির আন্দোলন ব্যতীত পুরুষতন্ত্র তথা পুঁজিবাদ ধ্বংস হবে না।
নারীমুক্তি আন্দোলন হলো এই পুঁজিবাদী এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে। সমাজের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে বদলাতে না পারলে নারীমুক্তি অসম্ভব। সত্যি বলতে কি এই বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু যুগে যুগে সমাজ প্রগতির লড়াইয়ে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ পরিলক্ষিত হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। ফলে সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা বদলাচ্ছে না। কারণ আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে অক্ষুন্ন রেখে নারীমুক্তি আন্দোলন অসম্ভব বিষয়।
যে কোনো আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করে শত্রুকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার ওপর। নারীমুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রেও পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্র আসলেই নারীদের শত্রু। এই সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। আর নারীকে সার্বিকভাবে পরাজিত, দুর্বল করে রাখা হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের কাছে। পুরুষতন্ত্র নারীকে জৈবিকভাবে-মানসিকভাবে অবদমন করছে। পাশাপাশি নারীকে তৈরি করছে ভোগ্যপণ্য রূপে। এতে নারী হারিয়েছে তার স্বাধীনতার অধিকার। নারী সার্বিকভাবে পরাজিত হয়েছে পুরুষতন্ত্রের কাছে। পুরুষতন্ত্র বলতে এমন একটি কর্তৃত্ববাদী সমাজব্যবস্থাকে বোঝানো হয়, যেখানে পুরুষই সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীকে ক্ষমতাহীন করে রাখে। আর এই সমাজব্যবস্থার ভিতরে রাষ্ট্র এমন এক শক্তি যা পুরুষতন্ত্রকেই ধারণ করে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সবসময় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, পুঁজিবাদ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের বিকল্প রূপ। অর্থাৎ পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যক্ষভাবে পুরুষতন্ত্রকেই প্রভাবিত করে। পুরুষতন্ত্র পুঁজিবাদের গভীরতম-হীনতম শোষণের জালের ভিত্তি। তাই প্রয়োজন পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন। যা নারীমুক্তির পথকে প্রসারিত করবে।
তবে এই সমাজ পরিবর্তন করার কাজ শুধু নারীদের নয়, নারী-পুরুষের সকলের। নারীমুক্তি আন্দোলনকে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন হিসেবে দেখতে হবে নারী-পুরুষ সকলকে। তাই এখন খুব বেশি করে প্রয়োজন নারী-পুরুষের সমতা। নারী ও পুরুষের সমতা হল- জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অংশগ্রহণ, সমান সুযোগ সুবিধা, সমান অধিকার, সমান ভূমিকা, দায়-দায়িত্ব, ক্ষমতা, সম্পদ-সম্পত্তি অর্থাৎ জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা। অর্থাৎ জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য নারী-পুরুষের সমান সুযোগ সুবিধা অর্থাৎ সম-অধিকার। সেই সঙ্গে যে ব্যবস্থা নারী ও পুরুষের অসমতাকে টিকিয়ে রাখে, নারীকে পরাধীন করে, সেই ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন করতে চাই নারীর ক্ষমতায়ন। ক্ষমতা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন সম্পদের উপর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হলে প্রতিষ্ঠিত হবে নারীর ক্ষমতায়ন। অর্থাৎ জীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করে সমতা প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়ার নাম নারীর ক্ষমতায়ন। তবে নারীর ক্ষমতায়নের লড়াইয়ে পুরুষদের বাদ দিয়ে পরিপূর্ণ সম-অধিকার আদায় সম্ভব নয়। কেননা, নারী-পুরুষের যৌথ প্রয়াসে সমাজ এগিয়ে গেছে। এই সমতা থেকে কেবল নারীরই লাভ হয় না। পুরুষ, পরিবার, সমাজ ও দেশ এর সুফল ভোগ করে। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীরা বৈষম্য থেকে মুক্তি পেলে তারা নানাভাবে তার সুফল ছড়িয়ে দেয়। নারীর ক্ষমতায়ন নারী-পুরুষের সমতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। তখন নারী-পুরুষের সাম্য শুধু নয়, প্রতিষ্ঠিত হবে মানুষে-মানুষে সাম্য। সকল বর্ণগত, ধর্মীয়, গোষ্ঠীগত অসাম্য দূর হয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে সব মানুষের সমানাধিকার-ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।
মানুষ হিসেবে নারীমুক্তির এই লড়াইয়ের আঘাত পরিচালনা করতে হবে গোটা পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তাই একদিকে পুঁজির শোষণ অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণের দাসত্ব থেকে গোটা সমাজকে মুক্ত করতে না পারলে নারীর প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়। এ সংগ্রাম আসলে ‘মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ’ নির্মাণ, তথা সাম্যবাদী সভ্যতা নির্মাণের জন্য সংগ্রামের সাথে সমার্থক।
লেখক: প্রগতিশীল নারী আন্দোলনের কর্মী, সদস্য, নারী সেল, সিপিবি