এই ত্যাগ মূল্যহীন নয়
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০১৭, ০১:৩৬
(১)
নারী দিবস ব্যাপারটা তো এখন বেশ চালু হয়ে গেছে আরকি। সকলেই নারী দিবস উপলক্ষে আশেপাশের নারীদের শুভেচ্ছা জানায়। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সবাই এই উপলক্ষে বাণী প্রদান করেন। গত প্রায় বিশ বছর ধরে দেখে আসছি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ৮ই মার্চ তারিখে একটা কার্ড পাঠায়। আর এখন তো সকলেই নারী দিবস এলেই ফেসবুকে কায়দা করে পোস্ট দেয়। এই সব তো ঠিকই আছে। নেতিবাচকভাবে দেখতে চাই না। ধরে নিচ্ছি সকলেই কোন না কোনভাবে উপলব্ধি করছেন যে নারী বঞ্চনার শিকার। এটাও নেহায়েত কম না।
কিন্তু নারীর মানুষ-মর্যাদা আদায়ের ব্যাপারটা ভিন্ন ব্যাপার। নারীর জন্যে খানিকটা মমতা কিংবা সহানুভূতি বা একটা দিবস উপলক্ষে সফল নারীদেরকে সম্মান দেখানো এইসব প্রকারান্তরে নারীকে মনে করিয়ে দেওয়া যে নারী তুমি পুরুষের তুলনায় পেছনে আছো। আপনারা যখন সফল নারীদের সম্মান দেন তখন আমি সেখানেও নারীর প্রতি অবমাননা দেখি। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে ধাঙ্গড়ের ছেলে এমএ পাস করেছে বা হাত কাটা ছেলেটা ফাস্ট বোলিং করছে বা পা কাটা ছেলেটা দৌড় প্রতিযোগিতায় জিতেছে। আপনারা যেন বলছেন যে, নারী তুমি যে সফল হয়েছ সেটা স্বাভাবিক না, তোমার তো সফল হওয়ার কথা না।
এবং আপনারা কি লক্ষ্য করেননি যে যেসকল লোকেরা সফল নারীদেরকে সম্মানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলছে ওরাই আবার সেইসব নারীদেরকে গালাগালি করছে যারা নারীর মুক্তির জন্যে লড়ছে। এমনকি সেইসব নারীরাও, যারা এই পুরুষবাদী সমাজে ক্ষমতাধর অবস্থানে থাকেন, ওরাও দেখবেন নারীমুক্তির লড়াইয়ে থাকা নারীদের নিন্দা করার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে খুব একটা পেছনে থাকেন না। ব্যাতিক্রম আছে, ব্যতিক্রম তো থাকবেই, কিন্তু সাধারণভাবে দেখবেন ক্ষমতাধর নারীরা আসলে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিই ধারণ করেন, পৃথিবীকে ওরা পুরুষের চোখেই দেখেন।
(২)
সেজন্যে পরিবর্তন দরকার। নারীমুক্তি বলেন আর নারীর মর্যাদা বলেন কোনটাই হবে না যদি পরিবর্তনটা না আসে। পরিবর্তন না বলে আসলে বিপ্লব বলাটাই অধিক সমীচীন হতো, অথবা বিপ্লব আর পরিবর্তনের মাঝামাঝি যদি আর কোন শব্দ থাকতো সেটা। কেননা নারীর পূর্ণ অধিকার আদায় ব্যাপারটার জন্যে যে মাপের পরিবর্তন দরকার কেবল পরিবর্তন বললে সেটা ঠিক পুরোপুরি বুঝা যায় না। পরিবর্তনটা কি মাপের জানেন? নারী শব্দটা বায়োলজি বই ছাড়া অন্য সব জায়গা থেকে উঠিয়ে দিতে হবে। এর চেয়ে কম পরিবর্তনে নারীর মানুষ-মর্যাদা অর্জন হবে না।
কে বলেছেন কথাটা? যে নারী আসলে নারী হিসাবে জন্ম নেয় না, জন্মের পর সমাজই একটি শিশুকে নারী হিসাবে তৈরি করে। এই ব্যাপারটা বন্ধ করতে হবে। এমনি এমনি তো বন্ধ হবে না, লড়াই করতে হবে। লড়াইটা চলছে, অনেকদিন ধরেই চলছে। চূড়ান্ত বিজয় কতদূর জানি না, কিছু কিছু গ্রাউন্ড তো এর মধ্যে দখল করা গেছে আরকি। খুবই সীমিত যদিও।
লড়াইটা কে করবে। নারী পুরুষ মিলেই করবে। অন্যভাবে বললে মানুষই লড়বে- যেসকল নারী ও পুরুষ নিজেদেরকে নারী বা পুরুষ ভাবার আগে মানুষ জ্ঞান করে ওরাই লড়বে। কেননা নারীর মুক্তির সাথে মানুষের মুক্তিও জড়িত। অঙ্গাঙ্গীভাবেই জড়িত। একদল নারী পুরুষ এই লড়াইয়ে ইতিমধ্যেই আছেন- লড়াইটা ওরা চালিয়েই যাচ্ছেন।
এই যে এরা লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন এই লড়াইয়ে পুরুষ যারা আছেন ওদের বিশেষ কোন সমস্যা হয় না। একজন পুরুষ যখন নারীমুক্তির কথা বলে, অন্য পুরুষরা সেটাকে ঠিক অতোটা প্রীতির নজরে দেখে না বটে। কিন্তু তাদেরকে সেরকম খুব একটা হেনস্থার মুখোমুখি হতে হয় না। হেনস্থা হতে হয় সেইসব নারীদের, যারা নিজেদের অধিকারের জন্যে লড়েন। যারা নিজেদেরকে পুরুষের চেয়ে কম মানুষ বিবেচনা করেন না। যারা নিজের নারী পরিচয় নিয়ে, নিজের নারী শরীর নিয়ে লজ্জিত না।
(৩)
আপনি কি সম্প্রতি লক্ষ্য করেছেন আমাদের এই ঢাকা শহরেই নারী অধিকারের জন্যে যারা সংগ্রাম করেন, লেখালেখি করেন বা কথা বলেন ওদেরকে কিভাবে কটুক্তি করা হয়? এবং এইসব কটুক্তি বিশেষভাবে নারীদেরকে লক্ষ্য করেই করা হয়। নারীবাদী শব্দটি নিয়েই তো কতরকম অবমাননাকর ইয়ার্কি করা হয় দেখেছেন! ফেসবুকেই আমি দেখেছি লোকজন বেশ কায়দা করে নসিহত করছে - এটা মানে নারীবাদ না ওটা মানে নারীবাদ না, এইরকম কাজ করলেই নারীবাদী হয় না, নারীবাদী হওয়া মানে কি ঐভাবে কথা বলা? ইত্যাদি ইত্যাদি।
ও ভাই, নারীবাদ বলতে আপনি কি বুঝেন আর নারীর অধিকার আদায়ের জন্যে কি করা উচিত আর কি করা উচিত না বলে আপনি মনে করেন সেজন্যে আপনাকে মোবারকবাদ। কিন্তু একজন নারী যখন তার নিজের অবস্থান থেকে নিজের অধিকারের কথা বলেন, তাকে তার নিজের ভাষায়ই করতে দেন, এবং তার নিজের কায়দায়। মেহেরবানি করে ওদেরকে নসিহত করতে যাবেন না। কেননা যে নারীটি নারীর অধিকারের জন্যে স্পষ্ট ভাষায় মুক্ত কণ্ঠে কথা বলতে পারেন, তার পথ ও মত ঠিক কি ভুল সেটা পরের কথা, কিন্তু তার সাহস ও সচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন করার কোন সুযোগ নাই।
নারীর ভাষা নিয়ে কতরকমই না কটু কথা বলেন আপনারা! আমি তো দুই একজন নারীকেও দেখেছি একইরকম কটু কথা বলছেন। নারী কেন নারীর শরীর নিয়ে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলবে। নারী কেন নারীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পোশাক অন্তর্বাস জৈবিক প্রক্রিয়া এইসব নিয়ে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলবে। এগুলো নাকি অশ্লীলতা, এসব নিয়ে লেখা নাকি অশ্লীলতা। এই যে আপনারা এদের লেখালেখিকে অশ্লীল বলছেন বা নিন্দা করছেন এটাও নারীকে ছোট করে দেখার একটা পুরুষবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। অশ্লীলতা নারীর পিরিয়ড বা স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে কথা বলার মধ্যে নয়, অশ্লীলতা আপনার মগজের মধ্যে।
(৪)
আশার কথা হচ্ছে মেয়েরা যারা লিখছেন, লড়াই করছেন ওরা সাহসিকতার সাথেই এসব মোকাবেলা করছেন। জেনে বুঝেই ওরা লড়ছেন। এই সাহসিকতাটা জরুরী। কেননা আজকের এই হাতেগোনা কয়েকজনের সাহসিকতা আগামীকাল হাজার নারীর সাহস যোগাবে। আজকে অল্প কয়েকজন নারী অনলাইনে লিখছেন, কাগজে লিখছেন, বই প্রকাশ করে বলছেন নারীদের লড়াইয়ের কথা। এরাই আগামীকালের হাজার নারীর চোখ খুলে দেবে। আগামীকালের হাজার মানুষের চোখ খোলার জন্যে আজকের এই কয়েকজন নারীর সাহসী পদক্ষেপটা খুবই জরুরী।
এজন্যে এবারে নারী দিবসের ওরা থিম ঠিক করেছেন 'পরিবর্তনের জন্যে সাহসী হও' বা Be Bold for Change এটা।
প্রতিটি নারীর জন্যে এই সাহসী হওয়াটা জরুরী। কেননা এই যে পরিবর্তনের জন্যে লড়াই, এই লড়াইয়ের প্রতিপক্ষ বড় কঠিন। প্রতিপক্ষ হচ্ছে প্রচলিত প্রথা, প্রতিষ্ঠান, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি সবকিছু। আর এদের প্রতিভূ হচ্ছে রাষ্ট্র, সমাজ সবকিছু। নারীকে ঊন-মানুষ থেকে সম্পূর্ণ মানুষের মর্যাদা অর্জন করতে হলে এই সবকিছুকেই হারাতে হবে। হারাতে হবে, লড়ে হারাতে হবে, ভাঙতে হবে- সংস্কার করে নারীর অধিকার অর্জন হবে না।
লড়ে হারানো খুব সহজ কাজ না। এইসব প্রথা প্রতিষ্ঠান ধর্ম যা কিছুই আছে সবই পুরুষবাদকে রক্ষা করে। এরা হচ্ছে জগদ্দল। হঠানো কঠিন। কঠিন আরও তার কারণ হচ্ছে নারীদের সকলেই কিন্তু এই সংগ্রামে চট করে যোগ দিবে না। নারীদের মধ্যেও অল্প কয়েকজনই কেবল লড়াইয়ে এগিয়ে আসবে। এটাই নিয়ম- লড়াইয়ের অগ্রভাগে অল্প কয়েকজনই থাকে। সকল নারীই কোন না কোনোভাবে নির্যাতিত। কিন্তু নির্যাতিত বলেই ওরা চট করে লড়বে সেরকম ভাববেন না। সেজন্যেই আপনার সাহসী হওয়াটা জরুরী।
(৫)
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। অনুষ্ঠান ইত্যাদি হবে, শুভেচ্ছাও জায়েজ আছে। শুভেচ্ছা জানাচ্ছি সকল নারীকে। অভিনন্দন নিন। কাল বেশ কয়েকটা শোভাযাত্রা হবে। চেষ্টা করবো কোন একটাতে যোগ দিতে। এসব তো ঠিকই আছে।
কিন্তু এই দিনটায় আমি বিশেষভাবে সেসব নারীদেরকে সালাম জানাই- যারা সাহসিকতার সাথে নারীর অধিকারের কথা স্পষ্ট ভাষায় বলে আসছেন। কেউ বই লিখেছেন, কেউ উইম্যান চ্যাপ্টার, জাগরণীয়া এসবে লিখছেন, কেউ ব্লগে লিখছেন, কেউ কেবলই ফেসবুকে লিখছেন- আপনাদের সবাইকে নতমস্তকে সালাম জানাই। আপনাদের সাহসিকতাকে সালাম জানাই।
একদিন আসলেই নারীমুক্তি হবে, নারীকে ঊন-মানুষ বিবেচনা করা হবে না, মানুষ আর মেয়েমানুষ দুইটা আলাদা মর্যাদার শব্দ থাকবে না। সেইদিন আপনাদের কথা আলাদা করে মনে রাখবে না। হয়তো কোথাও আপনাদের নাম উচ্চারণ হবে না। কিন্তু মনে রাখবেন সেই মুক্তির দিনটির জন্যে আপনারা আপনাদের আজকের দিনগুলি উৎসর্গ করেছেন, এই ত্যাগ মূল্যহীন নয়।
সংগ্রামী সকল নারীকে নতমস্তকে সালাম জানাই।
লেখক: আইনজীবী