ছেলে সুন্দর আয়ে, মেয়ে সুন্দর রঙে!

প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০১৭, ২১:০৪

কালো বা শ্যামলা হয়ে জন্মেছেন আর কোনো দিন এই নিয়ে একটি কথাও শুনেননি তেমন মেয়ে পাওয়া দুষ্কর। আমার পাশে যে মেয়েটি বসে রোজ তাকেও একদিন বলে বসি, "তোমার রঙ শ্যামলা তাতে কী, তুমি দেখতে সুন্দর”! অথচ আমার কাছে নাকি কালো সাদা সমান! যৌক্তিক চিন্তায় সচেতন মননে আমার কাছে কালো শ্যামলা ফর্সার প্রভেদ নেই। কিন্তু ঐ হাজার বছরের সংস্কার যা অবচেতন মনে রয়েই যায় তা মাঝে মাঝে কথা বলে উঠে। নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়ি। 

মেয়েটি এমবিএ পাশ, চাকরিরত, ভাল আয়কারীও। তবুও তার প্রেমিকের পরিবার বিয়ের কথা বলতে যখন বাসায় আসে তখন নাকি ছেলের খালা বলে, মেয়ের সবই ঠিক আছে শুধু একটু রঙ ময়লা। প্রেমের সম্পর্ক বলে হয়ত কেউ আর অমত করেনি। কিন্তু ঐ যে “গায়ের রঙ ময়লা” এমন চিন্তা বহন করে শ্বশুর বাড়ির প্রায় সকলেই। নিজ বাবা মাও বাদ যাবে কেন? তাদেরও একই দুশ্চিন্তা। মেয়ে তো তাদের সর্বগুণে গুণান্বিত, শুধু রঙটা! এমন দুশ্চিন্তায় মগ্ন ছিলেন আমার এক বান্ধবির বাবা মা। স্কুল শেষ করে এত বছর পর সেদিন হুট করেই তার সাথে দেখা। বাসা কাছে ছিল বলে গিয়ে বসলামও কিছুক্ষণ। এবং তার মায়ের রাতের ঘুম হারাম হওয়ার গল্প শুনলাম। মেয়ের সবই আছে, ব্যাংকে উচ্চ বেতনে চাকরিও আছে, শুধু পাত্র নেই। বলেই ফেললেন “ইশ একটু যদি উজ্জ্বল হত রঙটা”। শুনে বান্ধবির দিকে তাকালাম। কোনও ভাবলেশ নেই। বুঝলাম অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তবে ভাল লাগল বান্ধবির চিন্তাধারা দেখে। তার কোনো আফসোস নেই তার রঙ নিয়ে। সে জানে তার যোগ্যতা শুধু রঙ নয়। বরং রঙ তার জন্য কোনও যোগ্যতার মধ্যেই পড়ে না। সঙ্গি হিসেবে তাকেই গ্রহণ করবে যে তাকে তার মত করে ভালোবাসবে। শুনে মন ভরে যায়।
 
এখনো যখন ঘটা করে ছেলের জন্য পাত্রী খুজতে যায় ইচ্ছে করে কেউ শ্যাম বর্ণ পছন্দ করে না। সবারই সেই একই চাহিদা, মেয়ে সুন্দর শিক্ষিত হতে হবে। সুন্দর মানে কী? ফর্সা। সুন্দর বলতে শ্যাম বুঝি না, কালো তো অবশ্যই না। ছেলেদের  গায়ের রঙ কালো হলে বলে না যে এই ছেলের কপালে মেয়ে জুটবে না। “ছেলেদের আবার কালো ফর্সা কী” কত টাকা আয় করে এটাই মুখ্য। ছেলেরা সুন্দর তাদের আয় দিয়ে, মেয়েরা সুন্দর তাদের রঙ দিয়ে। 

ফুপাতো ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে, অবশ্যই ফর্সাই গ্রহণযোগ্য। অথচ আমার ফুপাতো বোনটি একদমই শ্যামলা বর্ণ। কালও বলতে পারে অনেকে। সেই বোনের বিয়েতে কী রকম এবং কত রকমের সমস্যা হয়েছিল নিজেই দেখেছি। প্রথমত পাত্র পাচ্ছিল না। শেষ মেষ ফুপা ফুপু হাল ছেড়ে দিয়ে যাই পায় যাকেই পায় ধরে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য বেপোরয়া হয়ে যায়। আর তার গায়ের রঙ ফর্সা করানোর জন্য এহেন কোনো ক্রীম ছিল না যা ব্যবহার করানো হয়নি। বোন আমার ছিল বোকা সোকা অল্প শিক্ষিত। আমার বান্ধবীটির মত সাহস মনন চিন্তা ছিল না তার। সে নিজেও হীনমন্যতায় ভুগত বিয়ে হচ্ছে না বলে। অথচ তার ভাইয়ের বেলায় চাওয়া হচ্ছে ফর্সা পাত্রী।
 
এই নিয়ে একটা স্ট্যাট্যাস দিয়েছিলাম, সেখানে একজন  কমেন্ট করেছে, “স্ত্রী ফর্সা না হলে ছেলে মেয়ে সুন্দর হবে কীভাবে?”। পৃথিবী নাকি এগিয়ে যাচ্ছে, আর এই উপমহাদেশের মানুষ ভাবছে, সন্তান কীভাবে ফর্সা হবে, তাও বাবা মার রঙ দিয়ে! বাবা মা ফর্সা, সন্তান কালো এমন অহরহ মানুষ পৃথিবীতে জন্মায়। 
 
আমার বিয়েতে দু'হাত ভর্তি মেহেদি ছিল। কড়া রঙের জন্য হাত দুটো কালো মনে হচ্ছিল।  কেউ কেউ  ভেবেছে আমার আসল রঙ এমনই কালো, মেক আপ দিয়ে চেহারা সাদা করেছি। ব্যাপারটা হাস্যকর ছিল কিন্তু আসল মর্ম ছিল আমি যদি উজ্জ্বল শ্যাম না হয়ে শ্যামলা হতাম তবে আমার খবর ছিল। আমার বাবা মা দুজনই শ্যামলা। সেই তুলনায় আমি তাদের মত হইনি বলে আমার মায়ের বড়ই আনন্দ। হেসে হেসে বলেও ফেলে “ভাগ্যিস রঙ আমাদের মত হয় নি তোর”।

এই “ভাগ্যিস” শব্দটা একটা কঠিন সত্য প্রকাশ করে। তোমার রঙ একটু ময়লা হয়েছি কি তুমি গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। অথবা তোমার গ্রহণযোগ্যতার জন্য তোমাকে ফর্সা মেয়েদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হবে। সবার আগে একটা ভাল ডিগ্রি নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তবেই তোমার রঙ নিয়ে মন্তব্য করার আগে এবং পরে তারা দুইবার চিন্তা করবে। তোমার রঙ নিয়ে আশেপাশের মানুষের  চিন্তা তুমি হাতে ধরে পরিবর্তন করতে পারবে না। কিন্তু তোমার নিজস্ব অবস্থান তাদের মুখে লাগাম দিবে। অথবা বলতে বাধ্য করবে কালো হলেও তো অনেক কিছু করেছে। অনেকেই শুধুমাত্র এই রঙের জন্য মনে করে যে তারা কিছু করতে পারবে না, তাদের চাকরি হবে না, তাদের কোনো উন্নতি হবে না। আশেপাশে তাকালে তাদের এই অন্ধ ধারণা লুপ্ত হবে। এমন অনেক মেয়ে আছে যারা প্রতিষ্ঠিত, সমাজে যাদের একটা অবস্থান আছে। যারা অনেক ফর্সা অবস্থানহীন মেয়েদের চেয়ে এগিয়ে।
 
যোগ্যতার মূল্যায়ন অবশ্যই হয়। প্রয়োজন নিজের উপর বিশ্বাস রাখা। “আমি কালো, তাই পারবো না” এই বোধ থেকে মুক্ত নিজেকেই করতে হবে। যদি অন্যদের কথায় হেরে যাও, নিজেই নিজেকে  অসুন্দর ভাবো তবে কোনকালেই কেউ তোমাকে গুরুত্ব দিবে না। মানুষের চিন্তাকে যত প্রাধান্য দিবে ততই তুমি নিজেকে তুচ্ছ করবে। মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে দাঁড়াও আগে এরপর থোরাই কেয়ার করো রঙ বিদ্বেষীদের!

লেখক: ব্লগার

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত