পরিবেশ রক্ষায় গণ মানুষের প্রতিরোধ

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০১৬, ২২:৩০

দক্ষিণ কোরিয়াতে একটি গ্রীন ভিলেজ আছে, ২০০৭ এর দিকে সেখানে কয়েকদিন কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। পাহাড় ঘেরা গ্রামটিতে জনসংখ্যা খুবই অল্প; অধিকাংশ বাড়িতেই বৃদ্ধ মা-বাবার সাথে কোরিয়ান ট্র্যাডিশন অনুযায়ী বড় ছেলে বাস করেন, যারা মূলতঃ কৃষক। ইন্টারনেট সুবিধার মত হাতে গোনা কিছু সুবিধা ছাড়া অধিকাংশ জিনিসই এখানকার জনগণ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন!

এখানে একটি গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয় আছে যার প্রেসিডেন্ট হলেন গ্রামের এই গ্রীন আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যেটা পড়তে চায় সেটা পড়তে পারে; আর্কিটেকচার, ওরিয়েন্টাল মেডিসিন, আর্ট-ক্র্যাফটসহ অন্যান্য অনেক বিষয়ই পড়ানো হয় সেখানে। একটা সময় পর বা বিশেষ লেভেল অতিক্রম করার পর শিক্ষক তাদের সার্টিফাই করেন। আমি এখানকার ছাত্রদের দেখেছি কাঠ দিয়ে নিজেরা হাতে কলমে পুরো একটি দোতলা বাড়ির ফ্রেম করছেন। 

এই গ্রামে একটি ডাইং কারখানায় গিয়েছিলাম যেখানে তারা কাপড় রঙ করছে মাটি, পাতাসহ অন্যান্য উদ্ভিজ্জ ও প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে। পাশেই পত্র-পুষ্প-ফল শোভিত বাগানের মাঝে একটি ছোট্ট ওয়াইন ফ্যাক্টরি; প্রাকৃতিক আর ভেষজ নানান প্রকার উপকরণে বিভিন্ন ধরনের ওয়াইন তৈরী হয় সেখানে। 

এই গ্রামটি আমার দেখা অদ্ভুত এবং সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম। ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশের গ্রাম দেখেছি, তবে কোরিয়ার এই গ্রীন ভিলেজ অদ্বিতীয় ও অনন্য! পৃথিবীজুড়ে প্রকৃতির উপর অপরিসীম উৎপীড়নের যে চর্চা চলমান তা থেকে নিজেদের শত-সহস্র হস্ত দূরে রেখেছে এখানকার সহজ শান্তিপ্রিয় মানুষেরা। অর্গানিক পদ্ধতিতে এখানে উৎপাদন হয় প্রচুর শাকসবজি ফলমূল - আপেল, পিয়ার্স, পিচ, প্লুম কি-না হয় এই ভিলেজে?

সবুজে পাহাড়ে ঘেরা শান্ত নিসর্গের মতো এই গ্রামটিতে হঠাত নেমে এলো এক দুর্যোগের ঘনঘটা। এখানকার সবুজ পাহাড়ঘেরা অপার্থিব সৌন্দর্য্যের মাঝে এক বেনিয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাইলো একটি গলফ কোর্স; ধনিক শ্রেণীর মানুষের বিনোদন আর ব্যবসার এ কাজে প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল সরকারের-ও। 

গ্রীন ভিলেজের জনগণ এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শুরু করলো আন্দোলন; কিছুতেই তারা তাদের প্রিয় এ ভূমিতে গলফ কোর্স হতে দেবে না। যদিও সরকারের এই গুটিকয়েক কৃষককে আর বুড়া-বুড়ীকে ধর্তব্যে নেয়ার প্রয়োজন নেই, তবুও এতো বাংলার মাটি না যে গণমানুষের মতামতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাতারাতি কিছু করে ফেলবে তারা।

যেহেতু কৃষিজমি ধ্বংস তথা প্রান-প্রকৃতি বিনষ্ট করে জনগন কোন ভাবেই এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখতে চাচ্ছে না ফলে গলফ কোর্স প্রকল্পের সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। কর্পোরেট লুটেরাদের শত প্রলোভন ও প্রণোদনাতেও এগোচ্ছিল না তাদের সাধের প্রকৃতিখেকো প্রকল্প।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রীন ভিলেজে যাওয়ার মূল কারণ ছিল সেখানে গড়ে ওঠা সেই সহজ কিন্তু শক্ত সামাজিক আন্দোলনটির স্বরূপ দেখা, আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া। গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয়ের আতিথেয়তায় আমরা জনা দশেক কয়েকদিন যাপন করি এখানে। এদের খাবার-দাবার আর পরিবেশ ছিল অন্যান্য জায়গা থেকে এক্কেবারে ভিন্ন। প্রাকৃতিক লীলাভূমির মতো ক্যাম্পাসে এখানে সেখানে মালঞ্চ ঝুলে আছে, ছাত্ররা হাতে কলমে মাঠে কাজ করছে গুরুর তত্ত্বাবধানে - কেমন যেন অদ্ভুত এক মনোরম অনুভূতির মিশেল সবখানে! 

দক্ষিণ কোরিয়ার এই গ্রীন ইউনিভার্সিটি তথা গ্রীন ভিলেজ ছবির মত সুন্দর। তারপরও বলতে হয় আমাদের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট প্রকৃতিগতভাবে ওই গ্রামের চেয়ে কম সুন্দর নয়, কম মূল্যবানও নয় - বরং আমাদের সুন্দরবন সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য! তারপরও আমরা কি গ্রীন ভিলেজের জনগণের মত করে আন্দোলন করছি, ভাবছি কি গ্রীন ভিলেজের জনগণের মত? ভাবছিও না।

যখনই রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয় তখনই সরকার লোডশেডিং করে জনগনকে টাইট দেন ইচ্ছামত। এই সস্তা ষড়যন্ত্র কি জনগণ বোঝে না? জনগণ কি এতোই আবুল যে সাধারণ সরল সমীকরণ বুঝতে পারবে না? 

সেদিন শহীদ মিনারে যে মানববন্ধন ছিল 'রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বিরোধী' এতে আমরা কতজন মানুষ অংশগ্রহণ করেছি? আমি নিজেই যেতে পারিনি। যানজটের কারনে আমরা শহরের এই মাথা থেকে অন্যমাথায় যেতে অর্ধেক দিন লাগে। এত জনবহুল একটি শহরে আমাদের বসবাস, তাহলে ফার্মগেটের ঐদিককার যত লোক আছে তার সিকিভাগ মানুষ গেলেও পুলিশ কি পারতো এই জনস্রোত রুখতে? পারতো শান্তিপূর্ণ যৌক্তিক দাবী নিয়ে রাস্তায় নামা দেশ ও প্রকৃতিপ্রেমী গণ মানুষের উপর লাঠি আর টিয়ারশেলের তাণ্ডব চালাতে? 

আপনারা হয়তো বলবেন দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ অবশ্যপ্রয়োজনীয়; কিন্ত নিশ্চয় তা সুন্দরবনের প্রান-প্রকৃতি ধ্বংস করে নয় - কারণ এই ম্যানগ্রোভও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়! আর ভারতীয় যে কয়লা এখানে ব্যবহার হবে সেটা এতটাই 'উচ্চমানের' যে অন্য কোন দেশ সেটা কিনছে না। সেই কয়লা আমরা নিজেদের দেশের প্রাণভোমরা সুন্দরবনের পশ্চাদ্দেশে বাঁশ দেবার জন্য ব্যবহার করছি। আজিব!  

মাননীয় সরকার বাহদুরকে উপদেশ দেবার লোকের অভাব নেই, ছিলোও না কোনকালে। তবুও বলি, সুন্দরবন হারাইলে পাইবে না আর তা ফিরায়ে; শত পাছা থাপড়ানিতেও! তাই বুদ্ধিমান হউন, ভাবিয়া কাজ করুন। 'নিজের খাইয়া বনের মহিষ তাড়াইতে পারঙ্গম জনগণকে' এতো তুচ্ছ তাছিল্য করিবেন না; উহারা পাড়াইয়া ধরিলে পালাইবার পথ পাইবেন না।  

লেখক: নৃবিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী এবং ভিজুয়্যাল স্টোরিটেলার

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত