গৃহিণী, তুমিও কিন্তু মানুষ!
প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ২০:৩৭
অফিসের কাজে মাঝে মাঝে ফিল্ড ভিজিটে যেতে হয়। যেহেতু আমার কাজ গুড়ো দুধ নিয়ে সেহেতু ডিরেক্ট কাস্টমারদের সাথেও কথা বলতে হয় মাঝেমাঝে। সেদিন কথা বলছিলাম কিছু গর্ভবতী মায়েদের সাথে। তাদের জন্য একটি দুধ আছে আমার কোম্পানির। সেই মেয়েদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল গৃহিণী। এর মধ্যে কয়েকজন পেলাম, যারা কোনভাবেই এই ফ্রি স্যাম্পল নিবে না! কেন? কারণ তারা স্বামীকে জিজ্ঞেস না করে কোনও কিছু খাবে না। বেশ অবাক হলাম। কী খাবো কী খাবো না সেটাও স্বামীকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে? তাও হাল ছাড়ি নি, বললাম “আচ্ছা আপনার স্বামীকে ডাকুন, কথা বলি। তারা সেটাও পারবে না। কারণ কারো 'স্বামী দেশে নেই', 'স্বামী এভাবে অপরিচিত কারো সাথে কথা বলা পছন্দ করে না', 'দেখলে রাগ করবে', 'স্বামী বলছে এসব না খেতে', 'সে যা দেয় তাই খাবে' ইত্যাদি।
অবশেষে হাল ছেড়ে দিলাম কিছুটা বিরক্ত হয়ে। একবার ইচ্ছে করলো জিজ্ঞেস করি “স্বামী বিষ খেতে বললে বিষ খাবেন?”
তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যানালাইসিস করলে বুঝা যায়, তারা কেউ যে অশিক্ষিত তা নয়। সকলেই নুন্যতম এইচ এস সি পাশ, অনেকে এর বেশিও হতে পারে। সকলের বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর কোঠায়। তবুও এমন দাসী টাইপ মনোভাব কেন? তাদের এই চিন্তার পিছনে দায়ী তাদের বেড়ে উঠা। তারা এমন পরিবার থেকেই এসেছে যেখানে তারা দেখেছে তাদের মা খালারা তাদের বাবা চাচাদের সাথে এভাবেই সংসার করছে। বাবা যাই বলে তাতেই মা'র হ্যাঁ। বাবা অন্যায় করছে না ন্যায় করছে, বিচার করার ক্ষমতা মায়েদের নেই। এমন পরিবার থেকে তাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, 'স্বামী মানেই কর্তা, সে যাই বলিবে যেমনই বলিবে তাহা অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতে হইবে, অন্যথায় সংসারে অশান্তি ঘটিবে'। মা’রাই তাদের বিবাহযোগ্য কন্যাদের শিক্ষা দেয়, “স্বামীর ঘর আসল ঘর, সংসারে ঝামেলা হবে, কথা কাটাকাটি হবে, ঝগড়া হবে; এই সব ঝামেলায় মাথা ঠাণ্ডা রেখে চলতে হবে, উলটো স্বামীর সাথে তর্ক করলে সংসারে অমঙ্গল হবে; মনে রাখবে ঐটাই তোমার আসল ঘর, বাপের ঘর না” । শিক্ষা দেওয়া হয় না “স্বামী যদি অন্যায় করে তুমি তার প্রতিবাদ করবে, মুখ বুজে পড়ে থাকবে না”।
এই শিক্ষা নিয়ে বড় হওয়া মেয়েরা কীভাবে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে? এদের মগজে মননে একটাই বিশ্বাস, স্বামী আমার ঈশ্বর। স্বামীই তো আমাকে খাওয়াবে পরাবে। এটাই তো নিয়ম। এই নিয়ম আর শিক্ষার চাপে কিছু মেয়েরা ভুলেই যায় যে তারা মানুষ। যারা নুন্যতম একটি খাবার স্বামীর অনুমতি ছাড়া কিনতে সাহস করে না, তারা কীভাবে স্বামীর অত্যাচারের প্রতিবাদ করবে? পারে না বলেই চড় থাপ্পড় খেয়ে মেয়েরা বিনা প্রতিবাদে পড়ে থাকে স্বামীর পা আঁকড়ে। কারণ তাদের অন্ধ বিশ্বাস স্বামী ভাত কাপড় দেয়, তাই স্বামী মারতেও পারে। স্বামীরা একটু এমন ব্যবহার করেই থাকে, মেয়েদের একটু সয়ে নিতে হয়, সংসার আর সন্তানের জন্য। রাগের মাথায় কিছু করলে ঘর ছাড়া হতে হবে, স্বামী আরেকটা বিয়ে করবে। তখন কী গতি হবে? কোথায় আশ্রয় পাবে? আশ্রয়দাতার মারও মধুর!
এই বোধের উন্নতি নেই আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে। আমাদের আশেপাশে অহরহ এমন চিন্তার নারীর বসবাস। হয়তো আপনার পাশের বাসার মহিলাটিও মার খাচ্ছে, কিন্তু 'ঘরের কথা বাইরে বলা লজ্জার' এই বোধের শিকলে বন্দী তারা। পদে পদে স্বামীর উপর নির্ভরতা চরম অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতেও বাধা দেয়। এই যে তারা কী খাবে সেটাও স্বামীকে জিজ্ঞেস করে খায় তারা কী কখনও স্বামীর পরকীয়ার প্রতিবাদ করতে পারবে? পারবে না। তারা কি কখনও স্বামীর অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে পারবে? পারবে না।
আমাদের মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা আমরা জন্মগত ভাবে পাই না। পরিবারই শেখায় একটু মানিয়ে নাও। এই মানিয়ে নেওয়ার ফল স্বরূপ স্বামীরা সগৌরবে পরকীয়া ধমকা-ধমকি শারীরিক মানসিক অত্যাচার চালিয়ে যায়। সে তো জানেই ঘরে বউ আছেই, সে তো আমার সম্পত্তি , তাকে উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে। 'আমি স্বামী আমি কর্তা' এই ধারণা পুরুষদের ভেতরে নারী তোমরাও ঢুকিয়েছ। তোমাদের চুপ থাকা, মেনে নেওয়ার অপরিসীম শক্তি তাদের স্বেচ্ছাচারী হতে অনুপ্রেরণা দেয়। তোমরা নিজেদের দুর্বল ভাবো আর মানো বলেই অন্যরাও তোমাদের সেইভাবে ব্যবহার করে। কেউ যদি তোমার কর্তা হয়ে উঠে মনে রেখো সেই কর্তা বানাতে তোমাদের অবদানের শেষ নেই। দাদি নানী মা খালা হতে যুগযুগ ধরে এই 'স্বামী যা বলে তাই ঠিক' চিন্তা উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে যাচ্ছে। আশেপাশে অহরহ গৃহিণী নারী। সবাই যে স্বামী বললেই খাবো এমন মনোভাব রাখে তা নয়, তবে মেনে চলতে হবে, মানিয়ে নিতে হবে, তিনি যা বলে তাই ঠিক, এমন ধারণার বসবাস আশেপাশে ছড়িয়ে আছে। এর মুক্তি বোধহয় এখনো অনেক দূরে।
লেখক: ব্লগার