প্রেম কখনও ‘অসম’ হয়?
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০১৬, ১৮:৫১
আমার কাছে একটা পত্রিকা লেখা চাইল। নারীদের জন্য পত্রিকা। আমার লেখা নিয়ে কাভারস্টোরি হবে। দুটো সাবজেক্ট তারা দিল, এক ‘অসম প্রেমের বিয়ে’ আরেকটি ‘পরকীয়া’। আমি খুব উৎসাহ নিয়ে বললাম, একটু বিস্তারিত বলুন। দ্বিতীয় শব্দটা নিয়েই আমার আপত্তি আছে সেটা নিয়ে পরে কথা বলছি, প্রথমটা বলেন, অসম প্রেম মানে কি? অসম বয়সের প্রেম? না অসম সামাজিক অবস্থা?
লেখা চাওয়া ছেলেটি কমবয়সী বললেন, ‘এই ধরেন অসম প্রেমে শারীরিক-মানসিক যেসব সমস্যা হয়, সামাজিক যে সমস্যা হয়, সেগুলো তুলে ধরবেন।’ আমার মেজাজ খিঁচড়ে গেল। আমি ছেলেটাকে ছোটখাটো একটা সবক দিলাম। বিনিময়ে সে মলিন কণ্ঠে বলল, ‘আপা আসলে কাভার স্টোরি তো আমাদের স্টাফরাই লিখবে, আপনি ঠিক আছে আপনার ভিউ থেকেই লেখেন’।
আমি বুঝলাম বেচারী নিতান্ত আমাকে মানা করতে পারছে না তাই বললেন, আপনার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে লেখেন, না হলে হয়তো মানাই করে দিতো।
আমি কি বললাম তাকে তার আগে একটা টিভি অনুষ্ঠানের কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করি। মাছরাঙা টেলিভিশনের একটা শো। অতিথি সুবর্ণা মুস্তফা। হোস্ট একজন লুতুপুতু সঙ্গীত শিল্পী। কথাও বলেন, সুললিত কণ্ঠে। ইন্টারভিউ করছেন। ছোটবেলার গল্প, স্টার বাবা, বোন, কাজ, খ্যাতি ইত্যাদি ইত্যাদির পর এলো ব্যক্তিগত জীবনের কথা। হোস্ট খুব আন্তরিক গলায় বলল, আপা এই যে সৌদ ভাইয়া কে আপনি বিয়ে করলেন, আপনার চেয়ে বয়সে তিনি অনেক ছোট। আপনার ভয় করেনি?
সুবর্ণা মুস্তাফা আমাদের অপর্ণা সেন-খুব স্ট্রলি তাকালেন হোস্টের দিকে। বললেন, ভয়? ভয় কেন লাগবে? আমি তো রাষ্ট্র বা ধর্ম বিরোধী কোন কাজ করিনি। বেআইনী কিছুও করিনি। তবে ভয় কেন লাগবে?
হোস্টের চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়! আমি ভাবি, সুবর্ণা মুস্তফার জায়গায় যদি বয়স্ক কোন স্টার অভিনেতা থাকতেন যিনি অল্পবয়স্ক মেয়ে বিয়ে করেছেন তাহলে কি ওই হোস্ট এই প্রশ্ন করতেন? বলতেন, আপনার ভয় লাগেনি?
আমার কাছে লেখা চাওয়া ছেলেটিও এভাবেই ভাবছে। সে একটা মেয়েদের পত্রিকা চালায়, কিন্তু মেয়েদের সবরকমের দাসত্ব আর শৃংখল থেকে মুক্তি দিতে যে সবার আগে নিজেদের মানসিকভাবে মুক্ত হওয়া প্রয়োজন সেটা তারা জানেই না। মাথার মধ্যে সেট করে বসে আছে যে, অসম প্রেম এবং বিয়ে মানেই শারীরিক, মানসিক সমস্যা। আসলে শারীরিক মানসিক সমস্যা হয় না কোন, যা হয় তা হলো সামাজিক সমস্যা। একজন নারী আর পুরুষ যখন বয়স বা অন্য যেকোন অসমতাকে পায়ে দলে বিয়ে বা প্রেমের সম্পর্কে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নয়, তারা তা নিজেদের ইচ্ছেতেই তো নেয়, তাই না? তাহলে শারীরিক মানসিক সমস্যা কেন হবে? সমস্যা হয় সমাজের মানুষগুলোর। সমাজ আমাদের মধ্যে একটা গিল্টি ফিলিং এর জন্ম দ্যায়। যার ফলে বলা হয় ‘অসম প্রেম’ বলা হয় ‘পরকীয়া’। সবসময় সম্পর্ককে আমরা একটা নির্দিষ্ট ছকে ফেলে দেখতে অভ্যস্থ। এর বাইরে গেলেই সেটা অসুন্দর, ছকের বাইরে গেলেই অসামাজিক। কিন্তু প্রেম যে ইটসেল্ফ একটা সুন্দর অনুভূতি, এই সম্পর্কটার এমনিতেই যে অনেক স্ট্রেন্থ আছে, বুজে যাওয়া নদীর মতো যেসব মানুষের জীবন সেসব মানুষের জীবনেও যে প্রেমের মতো সম্পর্ক নদীর জোয়ার আনতে পারে, বাঁচিয়ে তুলতে পারে-সেটা না ভুলি। পরিবারে, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সবজায়গায় এটা নিয়ে ফিসফাস, গা টেপাটেপি, গসিপিং-কেন? আর এসব হয় বলেই নারীর জন্য পত্রিকারও কাভার স্টোরি হয় ‘অসম প্রেমে মানসিক-শারীরিক সমস্যা!’
আর এ ধরণের সম্পর্কে সবচেয়ে বড় মানসিক নির্যাতনের শিকার কাকে হতে হয় জানেনই তো। একথা লেখাই বাহুল্য-নারীকে। তাকে শুনতে হয়, গতরখাকী, কচি ছেলের মাথা চিবানো, বুড়া বয়সে শরীরের খিদা মেটানো বেডি ইত্যাদি। ক্রমাগত লেখালেখির ফলে পত্র-পত্রিকাগুলোতে জেন্ডার ইনসেনসেটিভ শব্দ হয়তো লেখা কমেছে, কিন্তু এ ধরণের সম্পর্ক মেন্টেন করা যেকোন নারীর কাছে যান, শুনতে পাবেন তার অভিজ্ঞতায় এই শব্দগুলো।
তো আসলেই সমাজের দৃষ্টিভংগীর জন্য যারা এরকম ‘অসম’ সম্পর্কে জড়িয়েছেন তারা প্লিজ এইসব নিয়ে মুখ খুলুন। মুখ না খুললে অনেকটা ‘নিষিদ্ধ’র বেড়াজালেই থেকে যেতে হবে আপনাদের। আমাদের সমাজটা যতটা সম্ভব মানুষের স্বাভাবিক কামনা-বাসনা, মনোজাগতিক বেদনা ভাগাভাগিকে পায়ের তলে ফেলে মারতে চায়। সিস্টেম খুব জঘন্য একটা ব্যাপার। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই এই সিস্টেমের পিঠে লাত্থি না মারলে মুক্তি ঘটবে না। সমাজের মুক্তি ঘটানো নিয়ে না হয় নাই ভাবলেন, নিজের মুক্তির কথা ভাবি আমরা। এভাবে আলাদা আলাদা করে ঢেউ তুলতে পারলেও হয়তো একসময় বড় ঢেউ আসবে। আসবেই।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক