পরিবর্তনটাই পরিবর্তনশীল
প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৮:০১
মেয়েরা আদৌ কতটা স্বাধীন তা নিয়ে সংশয় টা থেকেই যায়, যখন আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে ব্যাখ্যা চলে। আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই আবার কিছু জায়গাতে না হলেও নয়। এই যে আমরা নারী সশক্তিকরণ নিয়ে এতো সব কথা বার্তা বলে বেড়াই তা কি আদৌ বলাটা আমাদের সাজে? সাজে, নিজেদের বুদ্ধিজীবী নামে আখ্যায়িত করতে বা এক কথায় জনপ্রিয় হয়ে উঠতে। আমি আসলেই আজ মুখবন্ধ প্রায়। আজ আর কোন নতুন পরিচিতি নেই নারীদের। পরিবর্তনটাও পরিবর্তনশীল। নারীর স্থানও আজ লাইনচ্যুত। একের পর এক ঘটে চলা ঘটনা অবলম্বনে আমাকে সত্যি আজ তাড়া করছে কিছু প্রশ্ন। যার উত্তর খুঁজে আজ আর পাই না।
বিগত অক্টোবরে ঘটে যাওয়া সম্প্রতি এক ঘটনায় আমি আসলেই অবাক। শিলচরের সংলগ্ন এক গ্রামাঞ্চলে (বেরেঙ্গা) বিশেষ একটি সরকারি অনুষ্ঠানে গিয়ে আমার এক অভিনব অভিজ্ঞতা হয় আর সেখানেই আরও বুঝতে পারলাম যে নারীদের স্থানটাকে, স্বাধীনতাকে কিছু সংখ্যক পুরুষেরা ঠিক কতটা নিচু করে রেখে দিয়েছে বা নিজেদের হাতের মুঠোয় বন্দী করে রেখেছে তার ইয়ত্তা নেই। একটি গ্রামের জেলা পরিষদের নেত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে তার স্থানটা আসলেই উনুনের কাছে, আর যাই হোক বড় কোন মিছিল কিংবা সরকারি/বেসরকারি কোন রাজনৈতিক বৈঠকে যোগদান করতে নয়। চোখের সামনে একজন লোক যেখানে তার স্ত্রীকে সেই সম্মান থেকে বঞ্চিত করে রাখে, সে কি আসলেই পুরুষ নামের কলঙ্ক নয়? তাহলে কোথায় গেল আজ সেই নারী মুক্তি চেতনার সেই বড় বড় ভাষণগুলো, যেখানে আমরা চিৎকার করে বলি, ‘বেটি বাঁচাও...বেটি পড়াও’। এই ভাবে একজন নারীর সত্ত্বা এবং অস্তিত্বকে লুকিয়ে রেখে তারা কি প্রমাণ করতে চায়?
তাই যদি হয়, একটি নারী ছাড়া পুরুষ এতোটা অসহায়, অচলই বা কেন তাহলে? তার উত্তর অনেকেই দিতে নারাজ কারণ তাদের বক্তব্যে এটাই প্রমাণ হয় যে নারী শুধু মাত্রই ঘরের শ্রী বৃদ্ধির জন্যেই। এটাই যদি প্রকৃত অর্থে নারীর স্থান হয় তাহলে বেটি বাঁচিয়ে আর পড়িয়েই বা কি লাভ? কেন এতো মিথ্যে ভাষণ? একজন পুরুষ যখন রাজনৈতিক ব্যাপারে নিজের স্ত্রীকে এগিয়ে দিয়ে পর মুহূর্তে তাকে ঘর বন্দী করে রাখে, এবং সেই স্ত্রীর জায়গা অটুট রাখতে সে নিজে পরিস্থিতি সামলাতে তার স্ত্রীর জায়গাটা নষ্ট করে, তাকে কি আসলেই মেনে নেওয়া যায়? এবং তার পরেই একটি লিখিত কাগজে সে যখন জেলা সাংসদের স্বাক্ষরের জায়গায় নিজের স্ত্রীর স্বাক্ষর এঁকে দিয়ে চলে যায় তখন তো এটাই প্রমাণ হয় যে সে কতটা নির্লজ্জ, নিজের হাতে যে নিজের স্ত্রীর সম্মানটাকে কেড়ে নিয়ে নিজের জায়গা করে নেয় তাকে আমি অন্তত মানুষ নামে পরিচয় দিতে পারি না কারণ আসলেই সে ওই জায়গারই শুধু নয়, তার স্ত্রীর মর্যাদার উলঙ্ঘনটাও করছে অনায়াসে নিজেকে ভালো রেখে। আর এটা অত্যন্তই নিন্দনীয়।
চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দেবী পক্ষের শেষার্ধে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী মীতার উপর হওয়া অমানবিক অন্যায়টাও আরেকটি নিদর্শন নারী সশক্তিকরণের। আজও বোধহয় ওর মা কেঁদেই চলেছে মেয়ের জন্যে। আজও সেই নৃশংস প্রাণীটি নির্দ্বিধায় শ্বাস ফেলছে যে মীতাকে চির নিদ্রায় শায়িত করে দিল খুব অল্প সময়েই। এই কি ভালোবাসার ছিরি? এরকমটাই তাহলে ঘটে চলবে আগামী দিনেও। নিরাপত্তার আশা রাখাটাই বৃথা?
সাতসকালে এটিএম এ দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন যখন এক নগ্ন পাগলির দিকে খিদের চোখে তাকিয়ে থাকে তখন তাকে/তাদেরকে ঠিক কি বলা উচিত? কম বয়সি, মাঝবয়স্ক, বৃদ্ধ সবারই শিক্ষা দীক্ষা তখন তুঙ্গে উড়তে শুরু করে। তাদেরই তো তাকিয়ে থাকতে দেখেছি যারা নারী সশক্তিকরণের কথা বার্তায় নিজেদের শামিল করেন, তাদেরকেও তাকাতে দেখেছি যারা নিজেদের বাড়ির মেয়েদের খুব শাসনে দায়িত্তে প্রতিপালিত করার চেষ্টা করেন, এমনকি এমন কিছুদেরও দেখেছি যারা রীতিমত নারীবাদী ও কথায় কথায় ফেমিনিজম ঝাড়েন। পরিবর্তন কি আদৌ হচ্ছে তাহলে? হ্যাঁ হচ্ছে, নিজেদের বাড়িতে বসে এক গাদা রোজকার ঘটনা নিয়ে ভাবছি, শুনছি, আর চুপ করে হজম করছি। নিরাপত্তা কি নারীদের ভাগে ছিল, যে আগামিতেও আমরা আশা করতে পারি? ছিল হয়তো কোন এক কালে, তবে আজ কোন ভাবেই বুকে হাত রেখে বলতে পারব না আমরা। শুধু মাত্র নারীমাত্রিক কথা বার্তায় নিজেরা মুখেতং মারিতং জগতং করেই বেড়াবো...
We say no to violence against women and girl বলছি আজ আমরা ঠিকই, কাজে করাটাই শুধু নির্ভর করে আমাদের চিন্তা, চেষ্টা, মানসিকতার মতো শব্দগুলোতে। পরিবর্তনটাই আজ পরিবর্তনশীল কিনা!
লেখক: লেখক ও আলোকচিত্র সাংবাদিক