স্বাভাবিক নয়

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০১৬, ২১:৩৫

সেদিন আপনা থেকেই ঘুম ভেঙে গেল সাড়ে চারটের দিকে। আমি তখন শিলচরে। নদীর ওপার থেকে ভেসে আসা প্রভাতী কীর্তনের সুরে ঘুম ভাঙেনি এর আগে কখনো আমার। কলকাতা শহরের সাউন্ডস্কেপে অভ্যস্ত আমার কান তাই ঘুম ভেঙেই অবাক। এত নৈঃশব্দ তাহলে সম্ভব যেখানে কীর্তনের পাশাপাশি মন্দিরার টুংটাং কানে ধরা পড়ে? এদেশেও এমনটা সম্ভব? বিষয়টা চূড়ান্ত অস্বাভাবিক ঠেকল।

২০১২ সালের মাঝামাঝির দিকে আমার গলার ভোকাল কর্ডে নডিউল ধরা পড়ে। ফলস্বরূপ গান গাওয়া প্রায় বছর খানেকের জন্য স্থগিত। কথা বলতে পারা দূরে থাক, নিঃশ্বাস নিতে চাইলেও তখন মনে হত কসরত করতে হবে প্রবল। ডাক্তার দেখানোর পর জানতে পারলাম, অসুখ বেশ জটিল। বুঝলাম, আমার আগের পাতলা, ক্যানক্যানে গলার স্বর আর ফিরবে না। মেনে নিলাম সেটাই। আশেপাশে সারাদিন, সারা রাত ধরে নানা রকমের চিৎকার-চেঁচামেচির ফলে আমাদের কন্ঠস্বর নাকি স্বাভাবিক ক্ষমতার পর্দার চেয়ে অনেকটা উঁচুতে বাঁধা পড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। আমার গলাও তাই করত। গাড়ির অপ্রয়োজনীয় হর্ন, চায়ের কাপে তুফান তোলা তর্ক, টিভি’র রিমোটের ক্ষমতা- সবকিছু অস্বীকার করে গলার পর্দা আরো চড়াতে থাকলাম আর শহর কলকাতার ‘স্বাভাবিক’ সাউন্ডস্কেপের বিপরীতে আওয়াজ তুলতে গিয়ে এভাবেই হারিয়ে ফেললাম আমার গান গাওয়ার, কথা বলার শক্তি, সামর্থ্য।

নাগরিক জীবনের বিরাট অংশ জুড়ে থেকে আসছে মানুষের সামাজিক স্বাভাবিকতার চেতনা। সেই চেতনায় বদল ঘটাতে বিশাল সংখ্যক মানুষের চরম বিরক্তি। যা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এতদিন, তাকে সেভাবেই রাখতে হবে। ভারতবর্ষে গাড়ির প্রচলন ঘটার আগে মানুষ হর্নের ব্যবহার জানত না। সুতরাং হর্নের আওয়াজকে আসন্ন বিপদের ধ্বনি হিসেবে না চিনতে পারাটা ছিল সেকালে স্বাভাবিক। যুক্তির পথ ধরলে সেই চিন্তা এখন না খাটাই উচিত। কিন্ত এমনটা মোটেও ঘটেনা। এই দেশে মানুষ হর্ন শুনলে ড্যাম কেয়ার। যতক্ষন না হর্নের আওয়াজে চালকের হতাশার চরম নিদর্শন যথেষ্টরূপে পরিবেশিত হচ্ছেনা, ততক্ষন হর্ন ব্যর্থ। শুধু তাই নয়, মানুষ রাস্তা তখনই পার করবে যখন গাড়ি এসে পড়বে তার শরীরের কয়েক ইঞ্চির ব্যবধানে। তার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সে থাকবে ঠায় মূর্তিমান। এটাই স্বাভাবিক। জেব্রা ক্রসিং, ট্রাফিক লাইট নিষ্প্রয়োজন।

নিয়ম, আইনকানুন লঙ্ঘন ভারতবর্ষে অত্যন্ত গণতান্ত্রিক একটি শিল্প নিঃসন্দেহে। এ বিষয়ে শহর থেকে প্রান্তিক গ্রাম- প্রায় সর্বত্র এক অদ্ভূত সামঞ্জস্য চোখে পড়ে। নিয়ম ভাঙার মধ্যে কী জানি কোন বীরত্বের গাথা পড়তে পাওয়া যায়, জানিনা। অবাক লাগে ভেবে,  যে এখনও খেতে পায়না দেশের অগুনতি মানুষ, অথচ আয়কর মকুব হতেই থাকে কোটিপতি চোরেদের। হয়ত এভাবেই অভ্যেসের মোড়কে এক আশ্চর্য স্বাভাবিকতার অলিখিত মডেল আমাদের প্রাধান্য দেওয়া শেখাতে থাকে। আমরা শিখি কার প্রাণের কত দাম, আর কারা নেহাতই মানুষের হিসেবে ফেলনা। উদাহরণস্বরূপ একটা গাছের কথাই নেওয়া যাক। কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই, সে আছে তার মত, রাস্তার ধারে। বেশী উঁচুও নয় যে পৌরসভার নেতাবৃন্দ এসে ছাঁটাই করে। বেশি ছোটও নয়, যাতে দুমদাম গাড়িরা এসে মাড়িয়ে না চলে যায়। এই গাছটি মাঝারি উচ্চতার। কিন্ত তা বলে নিস্তার নেই তারও। ভাঙা রাস্তার ধূলোয় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার কখনো, তো কোন পুরুষ তাড়ার মাঝে প্রকৃতির ডাকের বিষাক্ত জল ঝরায় তার ওপর। স্বাভাবিকতার নিয়মে মানুষের প্রয়োজনই প্রাথমিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর গাছ প্রতিবাদ করতে জানেনা।

আসলে আমাদের সমাজে হিংসা, ক্ষমতার অপপ্রকাশ এসব বড্ড স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। গাছের প্রতি তো বটেই, মানুষের ওপর হিংস্রতার নিদর্শনে যেভাবে ছেয়ে থাকে প্রাত্যহিক খবরের কাগজ, তাতেই স্পষ্ট এই অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতার কারণ। এই সমাজ, তার নির্ধারণ করে দেওয়া নীতি শেখায় রাস্তায় মৃত কুকুর দেখলে এড়িয়ে যাবার পাঠ। যেহেতু স্বাভাবিক বলে সমাজ এখনও মেনে নেয়নি, তাই চুম্বনরত প্রেমিক/প্রেমিকাদ্বয়কে হয়রানি করাটা নৈতিক কর্তব্য। যৌনতার কথা তো বাদই দিলাম। সামাজিক স্বাভাবিকতার দেশে জনসংখ্যা বাড়তেই থাকে বেহিসেবী, কিন্ত যৌনক্রিয়া থাকে বেডরুমের মশারির খাঁজে খাঁজে লুক্কায়িত। কালোটাকার মতই প্রায়। এমনই দাপট, প্রকৃতিকে অস্বীকার করতে চায় এই সমাজব্যবস্থা পদে পদে। যতবার ঋতুস্রাবে খুঁজে পায় অপবিত্রতার গোঁজামিল আরো বেশী করে যেন আস্থা রাখতে পছন্দ করে যতসব অলৌকিক, অবাস্তবে। আজব দুনিয়ার এই সমাজের নিয়মে ভালোবাসা, সৌন্দর্য সবই অস্বাভাবিক হতে থাকে। আর হিংসা, অন্যায়, মিথ্যা অধিকার করে স্বাভাবিক সত্যের আসন।

এখন বুঝি, ২০১২-য় আমার করা মারাত্মক ভুল আর সমাজব্যবস্থার গলদে খুব বেশী ফারাক নেই আসলে। দুজনেই ভেবেছিলাম গলার জোরেরই জয় হয় শেষ পর্যন্ত। ভুলে গিয়েছিলাম, শেষ কথা সব সময় বলে সেই সমস্ত সাবলীল উচ্চারণেরা যারা স্বতন্ত্র, শুধুই শক্তিমান নয়।

আর মনে পড়ে ইউক্রেন। সারি সারি সৈন্যের বীভৎস মূর্তির সামনে মানুষ কেবল কতগুলি আয়না ধরেছিল। নিজেদের রণমূর্তির প্রতিফলন দেখে কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও থমকে গিয়েছিল সেদিন তারা। সেনাবাহিনীর স্বাভাবিকতাকেই ব্যবহার করা হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে।

আয়না ধরাটাই আসল দায়িত্ব এখন। কারন গলায় নডিউল বাধালেও অন্ধ এখনও পুরোপুরি হয়ে পড়েনি মানবসভ্যতা। প্রতিবিম্বেই যাচাই হোক স্বাভাবিকতার, সত্যের।

লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত