আমরা মূলস্রোত, ডোডোরা নির্বাসিত!
প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০১৬, ০২:০৬
সব সময় চাইতাম আমার যাতে একটা বোন হয়। যদিও মামার মেয়ে, মানে তিতির, ছিলই, কিন্ত নিজের ঘরে মায়ের পেটের একটা বোন সব সময়েই চেয়ে এসেছি। কিন্ত ওই যে, যা চাইব তা কখনোই না পাওয়ার প্যাটার্ন। এবারেও হল তাই।
ঠাকুমার সংস্পর্শে একটু বেশিই উদ্বুদ্ধ হয়ে ছোটবেলায় আমি খানিক ভগবান-ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ছাতার মাথা বুঝতাম না ভগবান, ঠাকুর এঁরা কী প্রজাতির জিনিস। খায় না মাথায় দেয়। খালি এটুকু বুঝতাম যে বিশাল ক্ষমতাশালী। তো আশেপাশের মানুষ ছেড়ে আমি ভগবানকেই বেছে নিলাম আমার মুশকিল আসান করে দেবার জন্য। একটা ইয়া বড় চিঠি লিখেছিলাম। ইস্কুলে তখন সদ্য শিখেছি বাংলায় চিঠি লেখা। কায়দা করে ‘প্রাপক’ ও ‘প্রেরক’ লিখতেও ভুলিনি। তিন-চার পাতা লম্বা সেই চিঠিতে ছিল আমার সাত বছর বয়েসের নানা জীবনযন্ত্রণার কথা। যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলাম ঠিক কী কী কারণে আমার একটা বোনের ভীষণ প্রয়োজন। প্যাঁচে পড়লাম যখন চিঠিটা পাঠাবার সময় এলো। ভগবান কোথায় থাকে তা তো জানিনা! পাম্মু তো ওসব বলেনি কিছু। অনেক ভেবে বের করলাম সবাই ভগবান বললেই আকাশের দিকে তাক করে। তার মানে নিশ্চয়ই ওখানেই তার বসত। ওপরে, অনেক দূরে কোথাও। আকাশেই পাঠাব চিঠি স্থির করলাম। পিসি বা পাম্মু কাকে পটিয়ে যে দুখানা গ্যাস বেলুন জোগাড় করেছিলাম, সেটা অবশ্য এখন আর মনে নেই। তবে গ্যাস বেলুনের সুতোয় সযত্নে বাঁধা আমার চিঠিটা যখন নারকেল গাছের পাতায় লেগে পট করে ফেটে গেলো, সেই মুহূর্তের বুক চিনচিন ভুলতে পারিনা এখনও। চুপসে যাওয়া বেলুনের মত, চুপসে যাওয়া আমি সেদিনই বুঝেছিলাম আমার চাহিদার পরিণতি।
১৯৯৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারী মায়ের কোল আলো করে এলো ডোডো। আমার সাত বছরের ছোট ভাই। তার আগের দু’দিন মাকে হাসপাতালে গিয়ে দেখে এসেছিলাম। দিব্যি ছিল মা। কোন সমস্যা নেই। ঠিক যেদিন আমি সন্ধ্যে নামার আগেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম, সেদিনই ভাই এসে হাজির। শুনেছি পিসি নাকি অনেক চেষ্টা করেছিল আমায় ডেকে তোলবার। আমি পাত্তাই দিইনি। ঘুমের সামনে আমি কোনদিনই কিছু পাত্তা দিইনা।
ডোডো আর মা হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি এল। আমার মনে খুশি, কিন্ত তুলনায় অভিমানের পাল্লাই ভারী। প্রথমত, চাইলাম বোন আর হল ভাই। আর দ্বিতীয়ত, মা-বাবা-পিসি-পাম্মু-দাদ্দা সবার আদরে ভাগ বসানোর লোক সংখ্যা বাড়তে থাকায় কীভাবে খুশি হতে পারতাম, জানিনা। কিন্ত অবাক হলাম দেখে যে শুধু আমি না, বাড়ির বাকি মানুষদের মধ্যেও কেমন একটা যেন শুকনো, অখুশি ভাব। আমিও তো ছোটই। অত বুঝিনা। সুযোগ করে এটাই জানতে পারলাম যে আমার ভাইটা নাকি সবার ভাই-বোনেদের মত নয়। ও আলাদা। মনে আছে স্পষ্ট, এটা জানবার পর বেশ অনেকবার ডোডোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি আমি। কী নেই ওর বুঝতেই পারতাম না। ওই তো কেমন ছোট ছোট গোলাপি হাত-পায়ের আঙুল, মায়ের হাত পেলেই খামচে ধরে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা দুটো চোখ আর এক খাবলা ময়দার মত পুঁচকে একটা নাকওয়ালা আমার ভাইটার যে কী নেই সেটা এখনও আমার কাছে অপরিষ্কার।
ডোডোর ডাউন্স সিনড্রোম নামের একটা বিষয় আছে। অসুখ নয় মোটেও। বৈশিষ্টমাত্র। তার জন্যে সে আলাদা স্কুলে পড়ে, অন্যরকম আশ্চর্য সুন্দর সময় কাটায় এবং আমাদের জীবন আলো করে রাখে শুধুই তার অস্তিত্ব দিয়ে। কবে যে ডোডোকে এতটা মারাত্মকভাবে ভালোবেসে ফেলেছি, জানিনা। ভাই-বোন হলেই যে ভালোবাসতে হবে তা আমি বিশ্বাস করিনা। কিন্ত বিষয়টা হচ্ছে যে ডোডোকে না ভালোবেসে কেউ থাকতেই পারেনা। আপাতদৃষ্টিতে মানুষ আমাদের সাথে প্রথম পরিচয়ের পর ভাইকে খানিক করুণার নজরে দেখে থাকেন এটা লক্ষ্য করেছি। এতদিনে তাতে আমি অভ্যস্ত। তার সাথে ধেয়ে আসা অসংখ্য বোকা বোকা প্রশ্নও তাই এখন আর নতুন লাগেনা। আমি অবাক হই যখন দেখি ডোডোকে তাচ্ছিল্য করে যেই মানুষেরা, তাদেরও যখন ডোডো ভালোবাসতে কোন কার্পণ্য করে না। ও যে বুঝতে পারেনা, তা কিন্ত একদমই নয়। ডোডো সবই বোঝে। কখনো কখনো একটু বেশিই বোঝে।
২০১২’র শেষটায় আমরা রাজস্থান বেড়াতে গিয়েছিলাম। যোধপুরে হোটেলে একদিন সকালে খাবার টেবিলে বসে আছি চারজন। রেস্টুরেন্টের দরজা ঠেলে এগিয়ে এলো আরেকটি পরিবার। চারজন। অন্য একটি টেবিলে তারা আসনগ্রহণ করবার পরেই ডোডো আমার কনুই ধরে টানে। বলে,”দিদিয়া দেখ! দেখ! আমার মতন! আমার বন্ধু।” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সেই পরিবারেও একটা ছেলে। আমাদের অভ্যস্ত চোখ সহজেই চিনে নিল তার ডাউন্স সিনড্রোম। সেই পরিবারের সাথে এমনি খানিক ক্ষণ গল্প করেছিলাম আমরা। ভারী মিষ্টি, মজার মানুষ। কিন্ত আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। ওই কনুই টেনে বলা দুটো বাক্য শেষ করে দিয়েছিল আমায়।
সেদিন বুঝেছিলাম নতুন করে যে আমার, আমাদের ভালোবাসায় আসলেই কিছু যায় আসে না। যতই আগলে রাখি, যতই ভীড়ের মাঝে মিশিয়ে দিতে চাই না কেন, ডোডোর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা চোখে আমি আর সে কোনদিনও সমগোত্রীয় হব না। আমি তো ‘তার মতন’ হতেই পারলাম না।
সারাটা দুনিয়া জান-প্রাণ লড়িয়ে দিচ্ছে ডোডোকে, ডোডোদেরকে তাদের মতন করে তুলতে। মূলস্রোত বলে একটা শব্দ খুব শুনি আজকাল। আমরা সবাই মূলস্রোত। আর ডোডোদের জন্যে আজীবন শুধু নির্বাসন।
আমি বরং তার নির্বাসনেই ভাগ বসাব এখন থেকে। হাজার হোক, সাত বছরের ছোট ভাই আমার। সবেতেই জিততে দেওয়া যাবে না তাকে। কথা দিচ্ছি, ডোডো যতটা পারে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসব আমি। কথা দিচ্ছি।
ভাইফোঁটায় ডোডোকে দেবার মত এটুকুই আছে আমার কাছে বাকি।
এটুকুই সামর্থ্য। এটুকুই স্বপ্ন।
লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী