ধর্ম যার যার, মানবতা সবার
প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:৩৮
রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে যা যা জানি সেই জ্ঞানের পুরোটাই আমাদের চার ভাইবোনের মাঝে সবচেয়ে বড় প্রকৌশলী মম আসাদুল্লাহ যখন জাতিসংঘের UNHCR, আন্তর্জাতিক এনজিও MSF, ACF, Muslim Aid এবং Islamic Relief এর একটি সমন্বিত স্বল্পকালীন প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার তখন থেকে। তার কাজ ছিল প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গার জন্য অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প আর বাসস্থান বানানো। আমার মনে আছে সে যখন তার এই চাকরি নামের অ্যাডভেঞ্চারটি করতে গিয়েছিল তখন একবার আস্ত গাড়ি নিয়ে ২৩ ফুট খাদে পড়ে গিয়েছিল এবং প্রকৃতির অশেষ কৃপায় হাতে কয়েকটি সেলাই ছাড়া কোনোরকম ভয়াবহ আঘাত সে পায়নি! তার কাছেই জেনেছিলাম রোহিঙ্গাদের মাঝে যেমন অসৎ জঘন্য চরিত্রের লোকজন আছে, তেমনই নিতান্ত ভালোমানুষেরও অভাব নেই! কাজেই একটা জাতিকে ঢালাওভাবে খারাপ বা ভালো বলার অধিকার কারোর নেই। তেমনই অধিকার নেই এই অধিকারহীন মানুষগুলির অধিকারের সাথে বা অধিকারহীন জীবনের সাথে ধর্ম গুলিয়ে ফেলার এবং ধর্মকে গুলিয়ে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধাবার চেষ্টা করার।
কয়েকদিন ধরে দেখছি মায়ানমার থেকে অসংখ্য শরণার্থী অত্যাচারিত হয়ে পালিয়ে আসছে এবং বাংলাদেশ তার বর্ডার বন্ধ করে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। দেখতে খুবই কষ্ট হচ্ছে, কারণ বিপন্ন মানুষকে রক্ষা করাটা মানবিকতা। অন্যদিকে মায়ানমারের সকল মুসলিমদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে- বলে যে গুজব চারিদিকে রটে যাচ্ছে এটা ডাহা ভুল। অত্যাচার হচ্ছে মূলত রোহিঙ্গা নামের আলাদা গোষ্ঠীটির ওপরে। নির্যাতনের কারণটি পুরোপুরিভাবে ধর্মীয়ভাবে উপস্থাপন করাটা বিরক্তিকর। কারণ একবছর আগেই আমার বড় ভাই সেখান থেকে ঘুরে এসে জানিয়েছে- বৌদ্ধ ধর্ম প্রধান হলেও ওদেশে প্যাগোডার চেয়ে মসজিদ বেশি!
সবচেয়ে বড় অন্যায়টি করেছে মায়ানমার নিজে। কারণ- মায়ানমারে যে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আইন, সেখানে রোহিঙ্গাদেরকে সেই দেশের নাগরিক হিসাবে স্বীকার করা হয়নি!
মায়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশের নাগরিক বলে স্বীকৃতি দিতে চায়নি বলেই ওরা নিজেদের দেশে প্রবাসী হয়ে বাস করছে। নাগরিকত্ব যেহেতু নেই, কাজেই ওরা পাসপোর্ট পাবে না, সরকারী চাকরি পাবেনা, ভোট দিতে পারবে না, কোনো সম্পদের স্থায়ী মালিকানা পাবে না... ‘পাবে না’র তালিকাটি দীর্ঘ।
এই ‘পাবে না’ জাতীয় আইনটিতে আছে- চাইলে একজন রোহিঙ্গা নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করতে পারে, কিন্তু তার জন্য তাকে দলিল দস্তাবেজসহ যাবতীয় প্রমাণাদি দিয়ে প্রমাণ করতে হবে ষাট বছরের চেয়ে বেশী সময় যাবত সে মায়ানমারের বাসিন্দা। এটা প্রমাণ করা রীতিমতো মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো জয় করার মতন। কাজেই একজন রোহিঙ্গা মানে হচ্ছে সেদেশের একজন তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক, যার সামাজিক মর্যাদা হচ্ছে সর্বনিম্ন পর্যায়ের।
দীর্ঘদিন রোহিঙ্গাদের সাথে থাকা আমার ভাইয়ের কাছেই শুনেছিলাম- ওরা কেউই প্রায় মায়ানমারে যেতে চায় না। চাইবেই বা কেন! যেকোনো বার্মিজই রোহিঙ্গা নামটি শুনলে বড় বিরক্ত হয়। ওদের কথা হচ্ছে- রোহিঙ্গারা নিজেদেরকে বার্মিজ বলে না, আলাদা হওয়ার জন্যে ওরা মায়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছে, এখনো ওরা সেই যুদ্ধ চালু রেখেছে, যারা নিজেদের বার্মিজই বলে না তারা কি করে বার্মিজ নাগরিক হবে? কাজেই বার্মিজরা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলেছে টাইপের ব্যবহার সঙ্গত কারণেই দেখাবে!
লেখক ইমতিয়াজ মাহমুদের তথ্যমূলক একটি লেখায় নানান তথ্য-উপাত্ত বাবদ জেনেছি- মায়ানমারের স্বাধীনতার কয়েক বছর পরই রোহিঙ্গারা জেহাদ শুরু করে। রোহিঙ্গা মুজাহিরা মংডু ও বুছিডংসহ বিভিন্ন জায়গায় সরকারী অফিস আদালতে হামলা করে, নন-মুসলিম লোকজনকে মারে। এইরকম কয়েকদিন চলার পর বার্মিজ আর্মি কড়াকড়ি কয়েকটা অভিযান চালায় আর মুজাহিদরা অস্ত্র শস্ত্র ফেলে আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করে। এইভাবে বেশ কয়েকটা মুজাহিদ গ্রুপ জন্ম হয়েছে, সন্ত্রাস করেছে, আত্মসমর্পণ করেছে। এই সন্ত্রাসী মুজাহিদদের দাবী কি ছিল? ওরা মুসলিম, ওরা মায়ানমারের নাগরিকত্ব মানে না, ওরা রাখাইন প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে চায়। ওদের কারণে বহু সাধারণ বার্মিজ শুধুমাত্র অ-মুসলিম বলে মরেছে।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে রোহিঙ্গাদের আবার অনেকেই সেই ইসলামী জেহাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শরণার্থী শিবিরে ঢুকে এদেশের জঙ্গি তৎপরতায়ও যোগ দিয়েছে, এবং আশ্রয়দাতা বাংলাদেশেরও ক্ষতি করছে! কাজেই আশ্রয়শিবিরের এই রোহিঙ্গারা ছাড়াও যখন মায়ানমার সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকতে চাইছে বাংলাদেশে তখন বাংলাদেশও বিব্রত হয়ে তাদের জন্য বর্ডার খুলে দিতে পারছে না। মানেটা হচ্ছে- সাধারণ রোহিঙ্গারা এইসব জঙ্গি রোহিঙ্গাদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিক থেকে রোহিঙ্গারা সংখ্যায় যত কমই হোক, ওদের অধিকার আছে মায়ানমারের নাগরিক হিসাবে সেখানেই মর্যাদার সাথে বসবাস করার আর সেই দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার। তাই প্রধান কাজটা বাংলাদেশের না, কাজটা এখানে মায়ানমার সরকারের। তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয় তারা আমাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে না। তেমনই অসহায় মানুষগুলির জন্য যেন দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় সেজন্য প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কূটনৈতিক জরুরী প্রয়াস চালাতে পারে।
আমাদের দেশের একদল লোক রোহিঙ্গা সমস্যাকে মুসলিমদের সাথে বৌদ্ধদের বিবাদ হিসাবে দেখিয়ে ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি করতে চায়। এরা নিতান্তই অমানুষ ও নির্বোধ শ্রেণীর। ধর্মের গণ্ডির বাইরে যাদের চিন্তা ভাবনা বেড়ে ওঠেনি। এদের ধারণা অনুযায়ী হিন্দু সংখ্যালঘুর পক্ষে দাঁড়ালে বলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বলো। সেরকম রোহিঙ্গাদের নিয়ে বললে বলা হয় সাঁওতালদের নিয়ে বলো। এসব কথায় সাম্প্রদায়িকতার নোংরা চেহারা প্রকাশ পেয়ে যায়। সাম্প্রদায়িকতা আমাদের মন-মানসিকতা-মানবিকতা ক্ষুদ্রতর করে ফেলেছে। মুসলমান প্রতিবাদ করছে মুসলমানের জন্য, হিন্দু প্রতিবাদ করছে হিন্দুর জন্য। আর নাস্তিক হলে তো ধর্ম না মানাই তার কাল হয়েছে! অর্থাৎ, সার্বজনীন মানবতার চর্চা কোথাও নেই। অথচ এই মানবিক সহজ চিন্তাটা করলেই হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-ধর্মহীনসহ সব মানুষকে মানুষের কাতারে ফেলে হিসেব করা যায়, ধর্মের বাটখারায় নয়!
চে গুয়েভারা বলেছিলেন- "যখন তুমি সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠো, তখন তুমি আমার একজন সহ-যোদ্ধা।" কাজেই এই মুহূর্তে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নয়; সাময়িক আশ্রয়ের জন্য বর্ডার খুলে দেবার পক্ষে আমি। আমি সর্বদাই মানবতার পক্ষে। রোহিঙ্গারা জাতিগতভাবে মুসলিম বলে নয়, মানুষ বলে!