নারী যখন নারীর কাছেই বেশ্যা
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০১৬, ০০:১৪
এই সমাজের বেশিরভাগ পুরুষেরাই মেয়েদের দেখলে কু মন্তব্য করে। মেয়েটা যতই শালীন হোক না কেন তাদের কু মন্তব্য থেকে রেহাই পায় না, মেয়েরা তো বটেই এমনকি মায়ের বয়সী নারীরাও। এ বিষয়টা পুরুষের রীতিমতো মজ্জায় পৌঁছে গেছে। তারা যেন এ বিষয়টাকে একপ্রকার তাদের অধিকার মনে করে। তাদেরও যে ঘরে মা, বোন, স্ত্রী আছে তা তারা ভুলে যায়, ভুলে যায় তাদের মা, বোন, স্ত্রীদেরও দেখলে অন্য পুরুষ একই ভাবে কু মন্তব্য করে।
একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিললাম বাসে। এক পুরুষ দৌঁড়ে এসে বাসের জানালা দিয়ে আমার স্তনে হাত দিয়ে পালিয়ে গেল আমি বুঝে ওঠার আগেই। আমি ক্যাম্পাসে যাওয়ার পর খানিক সময় থম মেরে বসে ছিলাম ক্যাম্পাসের কড়ইতলায়। আমায় সিনিয়র বোনেরা বললেন কি হয়েছে তোর??
আমি ঘটনা বললাম।
তারা বললেন তোর এখন কি মনে হচ্ছে নিজেকে?
আমি বললাম, কিছুই না, কেননা এটা পুরুষের ব্যাধি। ওরা তাতে আক্রান্ত, আমি তো নই...!!
আমার মনে হয়েছে পুরুষরা নারীদেরকে পণ্য /বস্তু মনে করে। বয়স তাদের কাছে কোন বিষয়ই না। তাদের কাছে ৮ কিংবা ৮০ একই হিসাব।
কিন্তু অবাক করা বিষয় হল, যখন নারীরাই নারীদের দেখলে কু মন্তব্য করেন।
নারীরাই যখন নারীদের দেখলে মাগী বা বেশ্যা বলেন।
অনেক নারীরাই বলেন, ওই মাগী স্তন বের করে রাখিস কেন? মাথায় কাপড় দ্যাস না বেশ্যা মাগী...
হ্যাঁ, এই কথা আমিও শুনেছি। শুনেছি ওই পেট বাইর কইরা শাড়ি পরছোস কেন??
আমি বিস্মিত হয়ে ভেবেছি নারীরা এমন কথা কি করে বলে অন্য একটা নারীকে??
তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। তখন আমার কেবল মনে হয়েছে, ওইসব নারীরা হিংসা থেকে এসব কথা বলেছে। তারা নারী হয়েও নারীদের সহ্য করতে পারে না, পারে না নারী স্বাধীনতাকে মেনে নিতে। আসলে তারা নিজেরা হয়ত পরমুখাপেক্ষী। তারা নিজেদের অক্ষমতাকে প্রকাশ করতে পারে না। তারা নিজেরা হীনমন্যতায় ভোগে।
বেশ্যা বা মাগী যে একটা গালি যা নারীদের বিদ্রূপ বা ছোট করে দেয়া হয় তা ওই সকল নারীরা বোঝে না।
এর কারণ হচ্ছে, সতীর পুরুষবাচক সমার্থক শব্দ সৎ হলেও সৎ শব্দের আভিধানিক অর্থের সাথে শরীরগত সততা, তথা সোজা বাংলায় বদলে একগামীতার কোনো সম্পর্ক নেই। তেমনি করে নটী শব্দের অর্থ হিসেবে নর্তকী, নৃত্য যে নারীর উপজীবিকা, অভিনেত্রী এইসব শব্দের কথা বলা আছে। কিন্তু নট শব্দটি অভিধানে থাকলেও বাইরে প্রচলন নেই। কিন্তু বেশ্যা, শরীরী প্রণয়ী নারী অর্থে নটী শব্দের প্রচলন আছে বিশেষত নিম্নশ্রেণীর মানুষের মধ্যে। মাগী শব্দের অর্থ করা আছে: প্রাপ্ত বয়স্কা, স্ত্রীলোক, সাবালিকা নারী, বেশ্যা, গণিকা। আবার মরদ মানে: বেটাছেলে, যে ব্যাক্তির পুরুষোচিত গুণ রয়েছে, শক্তিশালী ব্যক্তি, বীরপুরুষ, যুবক, পতি, স্বামী। মাগী শব্দের সাথে বেশ্যা, গণিকা শব্দের সমার্থ করা থাকলেও এর পুরুষবাচক সমার্থক শব্দ মরদ-এর সাথে শারীরিক বেচা-কেনার কোনো সম্পর্ক নেই। তার মানে, ছেনাল-বেশ্যা শব্দের মতো এই শব্দগুলির অভ্যন্তরেও জারি আছে একই সেই ধারণা যে, একগামীতা, শারীরিক শুদ্ধতা, সতীত্ব এইসব শুধুই নারীর বিষয়। মানে নারী একগামী থাকবে, অনেকের সাথে শারীরিক সম্পর্ক থাকবে না, পুরুষ তাকে এই পুরুষতান্ত্রিক-পুঁজিবাদী মালিকানার যুগে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ইচ্ছেমতোন ব্যবহার করবে, ভোগ করবে কিনে নেয়া সম্পত্তির মতো।
আসলে যেসকল নারীরা নারী দেখলে এমন ভাষায় কথা বলে তারা পুরুষের শোষণের শিকার। সে সকল নারীরা বোধহয় ছোটবেলা থেকে ছোট গণ্ডীতে বড় হয়েছে, তাদের কাছে আকাশ মানে জানালার গ্রিল থেকে দেখা ছোট এক টুকরো। কোনদিনই তারা বৃহত আকাশের নাগাল পায় নি। পারেনি বড় কোন স্বপ্ন দেখতে। শুধু ভেবেছে কিছু লেখাপড়া করবে বা হয়ত অনেক লেখাপড়াও করতে পারে কিন্তু আত্মনির্ভরশীল হবে না। তারপর তাদের পরিবার বিয়ে দিয়ে দিবে। এরপর তারা পতি পরমেশ্বরে বিশ্বাসী হবে। স্বামী বা শ্বশুরবাড়ীর কেনা গোলাম হয়ে থাকবে। আর শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা ভাববে লেখাপড়া জানা একটা বুয়া পেয়ে গেলাম। আরও একটা কথা, তা হল, তাদের পরিবারে হয়ত তারা ছোটবেলা থেকেই দেখেছে ঘরের মেয়েদের সাথে সম্মানজনক আচরণ পুরুষেরা করে না। পুরুষেরা হয়ত কথায় কথায় গালি দেয়। তাই ওই সকল নারীরা পারিবারিক মূল্যবোধ শেখে না। তাদের গোড়ায়ই গন্ডগোল থেকে যায় এবং এই সকল ঘটনা হয়ত একজন বিবাহিতা নারী তার শ্বশুরবাড়ীতেও দেখে। ফলত তাদের হিসাব আরও পোক্ত হয়।
আরও লক্ষনীয় একটি বিষয় হল, তারা পরিবারে যাই শিখুক না কেন বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে না বা আগ্রহও পায় না। হয়ত তাদের বন্ধুমহলও তাদের মতই ছোট আকাশে বসবাস করে তাই তাদের বিকাশ সেখানেও কম। তাদের জ্ঞান ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ তারা নিজেরাই মুক্ত আকাশ দেখতে চায় না। এটা আসলে তাদের একপ্রকার মানসিক সমস্যা। নিজে না চাইলে কেউ তাদের এই সমস্যা থেকে বের করে আনতে পারবে না। কারণ আমি অনেক নারীদের দেখেছি যারা কনজারভেটিভ পরিবারে থেকেও অনেক উন্নত মানসিকতার অধিকারী।
কিন্তু বর্তমানে যদি আমরা চাই এখনকার ছোট্ট বাচ্চাগুলো এমনটা শিখবে না সে ছেলে কিংবা মেয়ে, তাহলে তাদের পরিবার এবং বাবা মাকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের বাচ্চাদের সাথে সুন্দর সময় কাটাতে হবে, তাদের সাথে গল্পের ছলে ভাল মন্দ বোঝাতে হবে। তাদের সাদা কালোর পার্থক্য শেখাতে হবে। ভাল বই পড়া, সিনেমা দেখানো, বড় বড় মনিষী, বড় বড় মানুষ যারা নিজ গুণে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে তাদের গল্প শোনাতে হবে। তাদেরকে স্বপ্ন দেখা শেখাতে হবে সর্বোপরি তাদের ভালোবাসতে হবে। কেননা রাগ করে, বকা দিয়ে, মেরে, বাচ্চাদের সঠিকভাবে মানুষ তৈরী করা যায় না, ধৈর্য প্রয়োজন। প্রয়োজনে প্রত্যেক মা- বাবাকে সন্তান জন্ম দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে কাউন্সিলিং করতে হবে।
শেষে কেবল এটুকু বলতে চাই, সেই সকল নারীদের, যারা রাস্তাঘাটে বা অনেক সময় পরিবারের অন্য নারীদেরও বেশ্যা বলে গালি দিয়ে থাকেন, দয়া করে আপনারা মুক্ত আকাশ দেখুন। একজন নারী হয়ে অন্য একজন নারীকে সম্মান দিন। আমরা যেদিন একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব সেদিন আমাদের সমাজে পরিবর্তন আসবে।
লেখক: সংস্কৃতিকর্মী