নারীর পোশাকে নয়, আপনার মগজের দিকে তাকান
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০১৬, ১৪:০৫
একটা মেয়ে যখন বাইরে বের হয়, সর্বক্ষণ এই চিন্তাটা তার মাথায় রাখতেই হয়; এই বুঝি ওড়নাটা সরে গেল, বারবার ওড়নাটা ঠিক করায় তঠস্থ থাকতে হয়। না হয়, পুরুষের কুদৃষ্টি মেয়েটির অসাবধানতার সুযোগ খুঁজে। রিকশা করে গেলে কামিজের ঝুল সমলাতে হয় বাতাসের ঝাপটা থেকে, না হয় রাস্তার পুরুষেরা তাদের চোখ দিয়ে খুঁজে নেবে নারী দেহের অবয়ব। মেয়েটির এই সার্বক্ষনিক তঠস্থটা তাকে বাইরের কাজে মনোনিবেশ থেকে শুধু দূরেই সরিয়ে রাখে না, বন্ধ করে রাখে তার সৃজনশীলতাকে। হ্যাঁ, পুরুষের কুদৃষ্টিতে হয়ত মেয়েটির শারীরিক কোন ক্ষতি হয় না, সতীত্ব (সতীত্ব শব্দটি নিয়েও আপত্তি আছে) কিংবা চারিত্রিক বিশুদ্ধতার কোন মাত্র সমস্যা হয় না। তথাপি, একটা মানুষ যখন অনুভব করে সার্বক্ষণিকভাবে কিছু চোখ তার শরীরের কিছু দিক খুঁজে বেড়াচ্ছে, তার স্বাভাবিক জীবনাচরণে এর প্রভাব পড়ে না কি!
অথচ, মেয়েটির এই আড়ষ্টতার জন্য সে নিজে দায়ী নয়, দায়ী পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি, ভুল সামাজিকীকরণ, ভুল সামাজিক শিক্ষা। একটা শিশু যখন ধীরে ধীরে পুরুষ কিংবা নারীতে পরিণত হতে শুরু করে, তখন থেকেই মেয়েটিকে বলা হয়; বড় হচ্ছো, এবার নিজেকে সামলে রাখতে শেখ। এই সামলে রাখা হলো পুরুষের দৃষ্টি থেকে নিজের নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গকে, শারীরিক অবয়বকে আড়াল করে রাখা। আড়াল করে রাখার জন্য মেয়েটিকে দেয়া হয় বিশেষ কিছু পোশাকের অনুমোদন এবং বাধ্যবাধকতা। যেন মেয়েটির এই শরীর তার জন্য এক কাল, একে আগলে রাখাই তার ব্রত। অন্যদিকে ছেলেটি জানতে শেখে সে স্বাধীন। কিছুদিন আগেও যে মেয়ে শিশুটির সাথে নির্দ্বিধায় খেলতে পারত, সে মেয়েটি এখন আর তার সাথে খেলবে না, ঘরেই থাকবে। কারণ, ছেলেতে মেয়েতে খেলাধুলা হয় না, হয় না পারষ্পরিক বন্ধুত্ব, শুধুই বিশেষ একটি শারীরিক সম্পর্ক হয়। ছেলেটি জানতে শেখে মেয়েদের শরীরে বিশেষ কিছু কামনার অঙ্গ আছে। মেয়ে হল পুরুষের কামনার সামগ্রী। তার দৃষ্টি মেয়েদের বিশেষ অঙ্গের জন্য লালায়িত হয়ে যায়।
এই লালায়িত দৃষ্টির কারণে পুরুষ যে কোন স্থানে, যে কোন সময়ে নারীর প্রতি তার কামনার বহিঃপ্রকাশ করতে দ্বিধা করে না। ইভটিজিং থেকে শুরু করে ধর্ষণের মত অপরাধে লিপ্ত হয়ে যায় এবং এর দায় মেয়েটির পোশাকের উপর চাপিয়ে দেয়। না, সমাজের সব পুরুষই এমন ইভটিজিং ও ধর্ষণে লিপ্ত নয়, ধর্ষক ছাড়া বাকিরা ব্যস্ত থাকেন ধর্ষিতার চরিত্র আর পোশাকের খুঁত অনুসন্ধানে।
একজন শিক্ষিত কিংবা সভ্য মানুষ হিসেবে ঘরে বাইরে সব জায়গায় আপনাকে উপস্থাপন করতে হয় মার্জিত মানুষের মত। পার্শ্ববর্তীজন হোক সে নারী কিংবা পুরুষ, হোক অবগুণ্ঠিত কিংবা নগ্ন, তাতে একজন সভ্য মানুষের কিছু আসে যাবার কথা না। বরং কেউ সমস্যায় পতিত হলে তাকে নারী-পুরুষ বিবেচনার ঊর্ধ্বে রেখে সাহায্য করাটাই হল সর্বোচ্চ মানবিকতা, সভ্যতা। কিন্তু, আমাদের সমাজ নারীদের শরীরের উপর চাপিয়ে দিয়েছে কিছু নিয়মের বেড়াজাল। নিয়ম মেনে নাও, সামলে রাখো, ঢেকে রাখো নিজেকে। না হয় নারীর গায়ে জুটে যাবে চরিত্রের অপবাদ। রাস্তায় কিংবা কর্মস্থলে সে নারীর যৌন নিপীড়িত হওয়াটা স্বাভাবিক। শিক্ষিত পুরুষেরা তখন গলা বাড়িয়ে বলেন, এতটা উগ্র হওয়াটা নারীর জন্য ঠিক না।
অথচ, রাস্তা হলো গন্তব্যের জন্য। কর্মস্থল কাজের। আপন আপন গন্তব্যে যান, আপন আপন কাজে মগ্ন থাকেন। কোন নারী কি পরে বের হল, কার অবয়ব কতটুকু বোঝা গেল, রাস্তায় এটা দেখা আপনার কাজ নয় হে পুরুষ। অফিসে কোন মেয়ে-কলিগ কড়া লিপস্টিক লাগিয়ে আসার মানে এই না যে সে আপনার কাছে ধর্ষিত হতে চায়। একজন ভাল মানুষ হিসেবে আপনার তো উচিত তার দিকে খেয়াল না করে নিজের কাজে মগ্ন থাকা। একজন শিক্ষিত ও সভ্য পুরুষ হিসেবে লজ্জা করে না যে আপনি কলিগের ঠোটের দিকে তাকান, বুকে নজর রাখেন!
নারীর পোশাকে নয়, আপনার মগজের দিকে তাকান।
লেখক: প্রবাসী বাঙালি