আর্ট অফ লিভিং
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২২:২৬
চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলাটা একটা আর্ট। সবাই পারেনা। সবাই শিল্পী নয়। কিন্ত চারপাশে আজকাল শিল্পীর প্রাচুর্য্য অন্য গল্প বলে।
আমার ফেসবুকে বন্ধু সংখ্যা প্রায় চার হাজার। এর বাইরেও আমি প্রায় শ’খানেক মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। এছাড়াও রোজকার আসা-যাওয়া, জীবনযাপনের প্রতিটি মুহূর্তে পরিচিত হতে থাকি নিত্যনতুন মানুষদের সাথে। এতগুলো লোকের সাথে আমার জীবন জড়িয়ে আছে, কিন্ত তাদের মধ্যে কেউই জোর গলায় ধর্ষণ বা কোন নারীর সাথে অভব্য আচরণের পক্ষে কথা বলেন না। কিন্ত এই আমার ২৪ বছর ৯ মাসের জীবনে এমন একটি সপ্তাহও পেরোয়নি যখন আমার মতের বিরুদ্ধে কেউ আমার গায়ে হাত দেয়নি, আমায় কুপ্রস্তাব দেয়নি বা অন্য কোন ধরনের যৌনহেনস্থায় পড়তে হয়নি। প্রথম কবে এমন হয়েছিল মনে নেই স্পষ্ট। ১২-১৩ বছর বয়েস হবে হয়ত। তার আগে, আরো অনেক অল্প বয়সে হেনস্থা হতে হয়েছে ঠিকই, তবে সাপ্তাহিক বা দৈনন্দিনতা ছিল না সেখানে। ওগুলো সারপ্রাইজ। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে এখন সেটাই অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।
এই অভ্যেসটা তো কেবল আমার একার নয়। আমার এত পরিচিত মানুষের মধ্যে যতজন নারী, তারা কেউই বুকে হাত দিয়ে বলেন না অন্য কোন ভাষ্যের কথা। তাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্পে এই একই ধারা অব্যাহত।
শুরুতেই বললাম, চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলাটা একটা আর্ট। সবাই পারে না। কেউ কেউ শিল্পী। এই শিল্পীরা সারাদিন মুখে জগত উদ্ধার করেন, নিজের মেয়ে-বোনেদের বিষয়ে কতটা উদার, কতটা সংবেদনশীল তা জনসমক্ষে ব্যক্ত করতে গলার ডেসিবেলের সাথে কোনরকম আপোষ করেন না। চোখে চোখ রেখে শুনিয়ে যান নিজের পবিত্রতার কাহিনী। গঙ্গাজলের মতই নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত পবিত্রতায় মোড়া এই শিল্পীরা জুটতে থাকেন ঘরে, বাইরে, হাটে বাজারে, স্কুল-কলেজ থেকে রাস্তায় সর্বত্র।
সাপ্তাহিক হেনস্থা কিন্ত এখানেই থেমে থাকে না। লেজুড় বেঁধে নিয়ে আসে আর নানা অভ্যেস। বাড়ি থেকে বের হবার আগে কতখানি চামড়া, মাংস দৃশ্যমান তা মেপে নিতে হয় রোজ। কোন রাস্তা দিয়ে, ক'টার সময়, কোন যানবাহনে, কার সাথে যাব সবটাই বিবেচনা করতে হয়। নাহলে মুখোমুখি হতে হয় আরেক বাস্তবতার।
গতকাল সন্ধ্যেবেলায় একটা ট্যাক্সি নিলাম। সাউথ সিটি মলের সামনে থেকে। গন্তব্য গোর্কি সদন। রাস্তায় অসম্ভব জ্যাম দেখে চালককে বললাম শর্টকাট নিতে। আমতা আমতা করে তাঁর জবাব, “যাব, দিদিভাই? আসলে সন্ধ্যের পর অলিগলি দিয়ে গাড়ি চালালে সমস্যা নেই, কিন্ত একা মেয়েকে নিয়ে গেলে আপনি কী ভাববেন জানিনা। অবশ্য দিনকাল যা, তাতে আপনাকে দোষ দেবনা কখনোই।” আমি বেবাক। অভ্যেসের ঠেকায় অল্প ছন্দপতন।
আবার এই একই পাড়াতে সেদিন নির্বিঘ্নে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। বাসস্টপের পাশে। আলোকিত রাস্তায় আমার পরনে ছিল ফুলহাতা সালোয়ার কামিজ। সাথে ছিল না কোন রক্ষাকর্তা পুরুষ, মদ্যপ ছিলাম না মোটেও আর ঘড়ির কাঁটা তখনও আটটা পেরোয়নি। আমার দুহাত দূরে দাঁড়িয়েছিলেন এক ব্যক্তি। গলায় ঝোলানো বিদেশি কোম্পানির আইকার্ড, গায়ে সাদা-নীল ডোরা শার্ট, কালো প্যান্ট, হাতে দামী মোবাইল, কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ। আপাতদৃষ্টিতে আমরা দুজনই সাধারণ, স্বাভাবিক। অনিয়ম বলতে ছিল শুধু আমার হাতে একটা সিগারেট আর পুরুষটির হাতে ধরা শিশ্ন। যেন একটা অন্যটাকে চরম প্রত্যাখ্যান করতে চাইছে বলেই উদ্ধত।
ব্যক্তিটির দিকে আমি ঠায় তাকিয়ে ছিলাম মিনিট দুয়েক। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে চেয়েও পারিনি। বারবার চোখের পাতা পড়ে যাচ্ছিল। সে কিন্ত আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল নির্দ্বিধায়। তার চোখ থেকে ছলকে পড়ছিল আত্মতুষ্টি, রাগ, ঘৃণা। আমি খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম তার চোখে অল্প অনুতাপ। পাইনি। বদলে নিজেই চোখ নামিয়ে রাস্তা পার হয়ে এসেছি একা। এপারে পৌঁছে দেখি সে তখনও তার লিঙ্গের মতই উদ্ধত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে এক অদ্ভূত বিজয়ের হাসি। সারা গায়ে চরম পরাজয় মেখে থরথর করে কেঁপে উঠেছি আমি বারবার। তবে এই গল্প নতুন নয়। এমন হাজার হাজার গল্প আমার একারও নয় আর।
একই ভাবে এই আইকার্ড ঝোলানো মানুষটি কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। হতেই পারত ফেসবুকের চার হাজারের একজন। স্থানের অদলবদলে তার সাথে মঞ্চের মাইক থেকে বাসের সিট- ভাগ করে নিতে পারতাম যা কিছুই। তার মিথ্যে বলার মুহূর্তে আমার প্রতি তার ঔদ্ধত্য রয়েই যেত অধরা, যেমন থাকে বেশির ভাগ মানুষেরই। এ যাত্রা তা আর হল না। মানুষ অভ্যেসের দাস না অভ্যেস মানুষের দাস, তাই ভাবি। একই দিনে ট্যাক্সিচালক ও গলায় আইকার্ড- থিসিস/অ্যান্টিথিসিসের টানাপোড়েনে আমার অভ্যেসের আর কোন সিন্থেসিস জন্মায় না।
আমি দর্শক হয়ে শিল্পীকে, তার শিল্পকে দেখি। কিন্ত প্রসেনিয়ামের মতই একটা ফাঁক থেকে যায়। সিন্থেসিস হয়না। অভ্যেস চলতে থাকে। অপরাজেয় থিসিস হয়েই।
অতএব, আমি অভ্যস্ত হয়ে পরেছি এতদিনে উদ্ধত চোখ, হাত, শব্দের বিপুলতায়। এই একই হাত যখন মিছিল-আকাশে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে, সেখানেই চিনেছি আমি চোখে চোখ রেখে উচ্চারিত মিথ্যের শিল্পকে। যে শব্দ শ্লোগান হয়ে ওঠে প্রতিদিন, কখনো আবার সেই কবির হাতই চিনিয়েছে আমায় অনাগত পরশের প্রতি জমে থাকা রাগ।
বুঝি, মোমবাতি হাতে নীরব থাকার মধ্যে তবুও বা কিছু সত্য আছে আজও।
কিন্ত সবচেয়ে বড় মিথ্যে জ্বলজ্বল করছে বাতি নিভে যাবার পরবর্তী মুখরতায়।
এ ক্ষেত্রেও ‘ঝড়কে পেলেম সাথী।’
লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী