অর্পিতা রায় চৌধুরী ও তার পরিবার কি ন্যায়বিচার পাবে?

প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:৪১

সুদূর জার্মানিতে পেন ইন্টারন্যাশনালের আর্থিক বৃত্তি প্রাপ্ত অর্পিতা রায় চৌধুরী নামীয় (যতদূর জানা যায় এটি তার ছদ্ম নাম) একজন তরুণীর মরদেহ সে দেশের পুলিশ উদ্ধার করেছে। মরদেহটি একটি বাথটাবে পড়ে ছিলো। এ পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, মেয়েটি কয়েকদিন আগেই মারা গেছে এবং সেখানকার পুলিশ ঘটনার অনুসন্ধান করছে। তারা মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এখনও নিশ্চিত করেনি। তবে প্রাথমিকভাবে এটি আত্মহত্যা বলে তাদের কাছে মনে হয়েছে- এমন সংবাদই শোনা যাচ্ছে। 

বলে রাখছি, জার্মানিতে এ ধরনের লাশ উদ্ধারের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে ২০০৪ সালে পেন ইন্টারন্যাশনালের আমন্ত্রণে যাওয়া বাংলাদেশের লেখক-গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হুমায়ুন আজাদের লাশও উদ্ধার হয়েছিলো, কিন্তু তার মৃত্যুর কারণ আজও রহস্যাবৃত।

এ ঘটনায় আরও যে বিষয়টি শোনা যাচ্ছে, তা হলো পেন ইন্টারন্যাশনালের আর্থিক সহায়তায় জার্মানিতে বসাবাসকারী তথাকথিত মুক্তচিন্তক যোবায়েন সন্ধি নামীয় একজন ব্যক্তি এ ঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে পারেন। কেননা অর্পিতাকে বাংলাদেশ থেকে জার্মানি নিয়ে যাওয়া, সেখান যোবায়েন সন্ধির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিলো। এই সন্ধি একজন বিকৃতি রুচির মানুষ হিসেবে অনেকের কাছে পরিচিত। যোবায়েনের সম্পর্কে এ রকম অনেক তথ্য পেন ইন্টারন্যাশনালও নাকি অবগত আছে।

সে যাই হোক না কেন, দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় কিছু মানুষ যখন বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন, তখন মুক্ত চিন্তকের ছদ্মবেশে একে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানোর প্রবণতাটিও তৈরি হয়েছে। ফলে অনেকেই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশ ছেড়েছেন, আবার কেউ কেউ অপেক্ষা করছে।

কে এই অর্পিতা চৌধুরী? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চাইতে জরুরি হলো, একটি মেয়ের লাশ উদ্ধার হয়েছে, তার মৃত্যুর পেছনের কারণ ও কিভাবে মৃত্যু হয়েছে তা জানা।কিন্তু সুদূর জার্মানিতে হওয়ায় এবং এর আগেও এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনায় কোনো রহস্য প্রকাশ না হওয়ায় বিষয়টি উদ্বেগজনক। কেননা অর্পিতা রায় চৌধুরী হয়তো ফিরে আসবে না কিন্তু তার মৃত্যু আত্মহত্যা না হত্যা সেটি জানা এবং আইনগত প্রতিকার পাওয়ার অধিকার অর্পিতার পরিবারের রয়েছে। আশা করছি অর্পিতার পরিবার ন্যায় বিচার পাবে।

প্রশ্ন হলো, আদৌ সেই সুযোগ আছে কিনা? পেন ইন্টারন্যাশনাল একটি আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী সংস্থা এবং জার্মানিতে বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে- এমন কোনো পদক্ষেপ সংস্থা এবং দেশটি নিবে কিনা, সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে কিছু বিষয়ে অবশ্যই প্রশ্ন তোলা উচিত যেমন- পেন সংস্থাটি জীবনের নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তায় যাদেরকে তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছেন, তারা কি প্রকৃত নিরাপত্তা পাচ্ছে? হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন, এটি তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এখানে তাদেরই বা কি করার আছে? বলতেই পারেন, কিন্তু প্রশ্ন হলো স্বাভাবিক মৃত্যুর শতভাগ নিশ্চয়তা থেকেই মানুষ তাদের দ্বারস্থ হয়ে সেখানে যাচ্ছেন, কাজেই এখানে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে কিছু নেই বরং এরকম তথাকথিত বিচ্ছিন্ন ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির দায় রয়েছে। একই সাথে একজন বিদেশি নাগরিকের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েও তার নিরাপত্তা বিধান না করতে পারায় রাষ্ট্র হিসেবে জার্মানিরও দায় রয়েছে।

যদি কেউ মনে করেন, আত্মহত্যার ঘটনা যদি ঘটে সেখানে এদের ওপর নিরাপত্তার দায় কিভাবে পড়ে? প্রশ্নটি যেমন খুবই স্বাভাবিক, তেমনি খুবই যৌক্তিক উত্তর হলো- আত্মহত্যাও কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। তাছাড়া একজন মানুষ যখন নিজ দেশে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়না বরং বেঁচের থাকার প্রশ্নেই দেশান্তরি হয়, এ রকম একজন ব্যক্তি যদি আত্মহত্যা করে, তাহলে এর পেছনে যে কারণগুলো থাকে তা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দানকারী রাষ্ট্রেই উদ্ভব। এ দিক থেকে রাষ্ট্রের দায় যথেষ্ট- অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

যেহেতু ২০০৪ সালে ড. হুমায়ুন আজাদের হত্যা না আত্মহত্যা না স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে- সে বিষয়টি এখনও রহস্যাবৃত, সে হিসেবে অর্পিতা রায় চৌধুরীর মৃত্যুর কারণ উদঘাটন হওয়ারও কোনো সুযোগ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সাধারণ মৃত্যুর বাইরে যে কোনো ধরনের মৃত্যুই হোক না কেন তার কারণ জানা যেমন জরুরি তেমনি ঘটনার দায়বদ্ধতার ক্ষেত্র এবং দায়ীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনাটাও যৌক্তিক। এ অবস্থায় অর্পিতার মৃতদেহ বাংলাদেশে এনে তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা প্রয়োজন। এখন এই কাজটি করার প্রক্রিয়া কি হবে? সে ক্ষেত্রে অর্পিতার পরিবার বাংলাদেশের জার্মান অ্যাম্বাসির মাধ্যমে তাদের সরকারের কাছে দাবি জানাতে পারে এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিবারটিকে সার্বিক সহায়তা দিবে। আবার দায়বদ্ধ দেশ হিসেবে জার্মানিরই উচিত পরিবার দাবি তুলুক বা না তুলুক তাদের বাংলাদেশ অ্যাম্বাসির মাধ্যমে পরিবারটির সাথে যোগাযোগ করে তাদের সন্তানের মৃতদেহ এবং ক্ষতিপুরণ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে প্রদান করা। অপরদিকে বাংলাদেশ সরকার তার দেশের একজন নাগরিকের মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন এবং বিষয়টি যদি ফৌজদারি অপরাধের আওতাভুক্ত হয় তাহলে ঐ দেশের আইনী কাঠামোতে বিচারের ব্যবস্থা করতে পারে অথবা নিজে দেশের আইনী বিধান অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে, এ জন্য সরকার নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দু কারণেই দায়বদ্ধ।

এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বাংলাদেশ থেকে অপরাধমূলকভাবে অর্পিতাকে নিয়ে যাওয়া হলে, অপরাধে যুক্ত ব্যক্তি এবং যদি এমনটিও মনে করার কারণ থাকে, যে কোনো ভাবেই হোক এই অপরাধে পেন ইন্টারন্যাশনালের অবহেলা বা যুক্ততা রয়েছে তাহলে তাদের সকলের বিরুদ্ধেই আইনী পদক্ষেপ নিতে পারেন। একই সাথে জার্মান সরকারের কাছে ক্ষতিপুরণ দাবি করেও আইনী পদক্ষেপ নিতে পারেন।

কোনো মৃত্যুর ঘটনাকেই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু অর্পিতার পক্ষে কেউ কিংবা তার পরিবার কি এই চ্যালেঞ্জ নিবে? অর্পিতা ও তার পরিবার কি ন্যায়বিচার পাবে? আমাদের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো।

অর্পিতা রায় চৌধুরীর জন্য ন্যায়বিচার চাই।

লেখক: আইনজীবি

 

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত