অরিত্রীদের অন্ধকারে
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ২১:৫৯
আমেরিকান হাইস্কুলে আমার সাথে একটা মেয়ে পড়তো- সিরিয়াস টাইপ স্টুডেন্ট, লেখাপড়াতে যেমন ভালো ছিলো, তেমন তার আচরণও সুন্দর ছিলো। আমার প্রায় পুরো হাইস্কুল কেটেছে "আমি আমেরিকায় নতুন, এই কালচারে নতুন, আমি বোধহয় মানিয়ে নিতে পারবো না" এই হীনমন্যতায়, তাই সুন্দর আচরণের কাউকে পেলে মনে থাকতো। এই মেয়ে আমার বন্ধু হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাকে আমার মনে ছিলো। হাইস্কুল পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার বেশ অনেক অনেক বছর পর ফেসবুক মারফত তাকে খুঁজে পেলাম, বন্ধুতালিকায় যোগও করলাম। এখনো যে বন্ধু হয়েছি, তেমনও না। হাইস্কুলেরই মতো, তাকে মুখচেনা চিনি, তার আচরণ ভালো লাগে, ফেসবুকে মাঝে মাঝেই নিউজফিডে তার স্বামী সন্তানসহ তার হাসিমুখ যখন ভেসে আসে আমি একটা 'লাইক' দিয়ে যাই।
কিন্তু এখন আমাদের দুজনারই জীবন আকাশ পাতাল পাল্টেছে। আমি সেই হাইস্কুলের হীনমন্যতায় ভোগা মেয়েটি যেমন এখন নই, সেই মেয়েটিও কেবলমাত্র সেই আপাতদৃষ্টিতে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে আর আটকে নেই। আমি ফেসবুকে তাকে যোগ করার বেলায় দেখলাম, এখন সে একটি ফাউন্ডেশনের সাথে কাজ করছে। যে ফাউন্ডেশনটি সে নিজে গড়েছে, যে ফাউন্ডেশনটি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত টিনএজারদের কাউন্সেলিং থেকে শুরু করে মেডিক্যাল চিকিৎসা দেয়, যে ফাউন্ডেশনটি আত্মহত্যায় প্রিয়জন হারানো পরিবারদের বিভিন্ন সাপোর্ট দেয়, যে ফাউন্ডেশনটি এইসব ব্যাপারে সচেতনতা তৈরী করে। আমি কৌতূহল থেকে যখন এই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে পড়ছিলাম, তখন জানলাম আমার সেই সহপাঠী আমাদের হাইস্কুল পাশের দুই বছরের মাথায় তার ছোট ভাইকে হারায়- সে একটি মানসিক ব্যাধিতে ভুগতো, সেই থেকে সে একদিন ডালাসের একটি উঁচু দালানে যায়, সেই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে।
আমার অসম্ভব কষ্ট হয়েছিলো সেদিন, সেই ভাইটির কথা ভেবে, আর সেই ভাইটির এই বোনটির কথা ভেবে। কতটা কষ্ট এই মেয়ে তার বুকে চেপে রাখে, আমি জানি না। কিন্তু তার দৃঢ় প্রত্যয় এখন, সে যদি আর এমন কোন টিনএজারকে বাঁচাতে পারে, সে যদি বাকি মানুষদের মনে সচেতনতা তৈরী করতে পারে, সে যদি এমন মানসিক রোগের আরোগ্য খুঁজে পেতে পারে, তাহলে সে তা করবে। তার কাজের আরেকটি বড় অংশ- এইসব নিয়ে মানুষের মনে যে লজ্জাভাব বা কলঙ্কবোধ বেহুদাই তাড়া করে, সমাজে সচেতনতা বাড়িয়ে সেগুলোও সে দূর করবে।
তার ফাউন্ডেশনটি একমাত্র নয় যেগুলো এসব নিয়ে কাজ করে। কিন্তু এই মেয়েটির নিজের জীবনে এমন একটি ট্রাজেডি আছে বলেই বুঝি সে নিজে অংশীদার হতে চেয়েছে এমন লক্ষ্যে। তার প্রতিষ্ঠানটি তাই ডালাসে আরো কিছু আমেরিকান সংগঠনের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে।
আমি এই মেয়েটির গল্পটি ভাগ করছি একটি ভাবনা থেকে- আমরা যখন কারো আত্মহননের খবর শুনি, তখন অনেকেই আমরা সেই হারানো প্রাণটিকেই দোষ দেই, তাকে ভীরু বলে ডাকি, তাকে ঘিরে আলোচনা করি "আত্মহত্যা কোন প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না"; আমরা এমনকি জীবনযুদ্ধে লড়াই করার প্রেরণা দেয়ার ছলে এমনও বেফাঁস বলে ফেলি- "যদি তুমি আত্মহত্যা করো, আত্মহত্যার কথা ভেবে থাকো, আমরা তোমার সঙ্গে নেই। যদি তুমি লড়াই করো, আমরা তোমার সঙ্গে আছি।"
আমরা এটাও ভাবি, যদি কারো আত্মহননের নেপথ্য কারণ নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে হয়তো আত্মহত্যা করাকেই উৎসাহ দেয়া হবে। আমরা ধরেই নেই, একজন অপমান সইতে না পেরে নিজের জীবন নিয়ে থাকলে হয়তো একই রকম অপমানের শিকার আরেকজন একই কাজ করতে পারে, তাই এই খবরগুলোকে "গ্লোরিফাই" না করাই ভালো।
কিন্তু আমরা সবাই যদি নিশ্চুপ হয়ে থাকি, সবাই যদি আত্মহননে জীবন হারানো ভুক্তভোগীদের এমন নিচু চোখে দেখি, তাহলে কি আসলেই তাতে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রত্যয় পাওয়া যায়? তাহলে কি নেপথ্যের কারণগুলোর কোন সমাধান কখনো হয়?
আমি আত্মহনন নিয়ে একটি লেখাতে বেশ কয়েক বছর আগে একটি উপমা পড়েছিলাম, যা আমার ভাবনার গতিপথ পাল্টে দিয়েছিলো- মনে করুন আপনি উঁচু একটি দালানে আটকে পড়েছেন, সারা বিল্ডিং-এ আগুন লেগে গেছে, আগুন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে সেই উঁচু দালান থেকে লাফ দেয়া। কিন্তু দালানটি এতই উঁচু যে লাফ দেয়া মানে আপনার নিশ্চিত মৃত্যু। আপনি তখন কি করবেন? লাফ দিয়ে মরবেন, নাকি আপনি আগুনে পুড়ে মরবেন? আমার পড়া উপমাটি এটাই বলছিলো, চরম ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকা কোন মানুষ যখন আত্মহননের পথটি বেছে নেয়, তার কাছে মনে হয়, তার আর কোন পথ খোলা নেই। তার জীবন তার কাছে আগুনে মৃত্যু, আর তার পরিত্রাণ সেই উঁচু দালান থেকে ঝাঁপ। অর্থাৎ, সে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখান থেকে মৃত্যুকে বাছে না, সে দুটো মৃত্যুর মাঝ থেকে একটি মৃত্যুকে বাছে।
আত্মহনন পরিত্রাণের উপায় তবে কি? সেটি নিয়ে চুপ হয়ে যাওয়া নয়। বরং, আমার সেই সহপাঠীর মত বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানো। সে তার ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনা লুকায়নি, সেটা নিয়ে কথা বলাকে সে আর কাউকে আত্মহত্যার উৎসাহ দেয়া হিসেবে ভাবেনি। বাস্তবতা হলো, বয়স থেকে শুরু করে মানসিক স্বাস্থ্য, সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ, বেশ কিছু কারণেই অনেকেরই চোখে 'জীবন' ধরা দেয় না, কেবল মৃত্যুকেই তাদের পথ বলে মনে হয়। তাই সে নির্দিষ্টভাবে টিনএজারদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে, তাই সে অভিভাবক মহলে সচেতনতা তৈরী করে, যেন এমন চিহ্নগুলো কারো চোখ এড়িয়ে না যায়। সবাই এমন চুপ হয়ে গেলে সেই চিহ্নগুলো চোখের সামনে ধরা দিলেও আমরা বুঝবো কি করে? চুপচাপ কি আর কোন কষ্টে আক্রান্ত প্রাণ অকালে ঝরে যেতে পারে না আমরা সবাই না দেখার ভান করে যেতে থাকলে?
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারী আর আমাদের মাঝে নেই। কেন নেই, সে আঙ্গুল স্কুল কর্তৃপক্ষের দিকে যায়। সেই স্কুল, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, আমাদের শিক্ষকদের এলোপাতাড়ি ছাত্রদের উপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা, আমাদের অভিভাবকদের সেসব মেনে নেয়া, আমাদের অভিভাবকদের নিজেদের এমন অত্যাচার করা, আমাদের সমাজে আমাদের শিশু-কিশোরদের মানুষ হিসেবে না দেখে কেবল 'ছোট' হিসেবে দেখে অনেকভাবেই ছোট করা- এই মৃত্যুর রক্ত লেগে গেছে আমাদের অনেকেরই আঙ্গুলে।
এখনই সময়, আমরা যেন আর অমানবিক না হই, আমরা যেন প্রত্যেকেই আরেকটু সংবেদনশীল হই, সচেতন হই। আর সেটির শুরু হতে পারে প্রিয় অরিত্রীর প্রতি আমাদের সমবেদনায়। এখন সময় নয় বলবার, "কই, আমি তো কত মার খেয়েছি শিক্ষকদের হাতে, কখনো তো ভাবিনি তার জন্য মরে যেতে হবে!" এখন বরং সময় ভাববার- এমন অরিত্রী অধিকারী আমার আশপাশে নেই তো? যদি থাকে, আমি কি করতে পারি তার জন্য? আমি নিজে এমন কিছু করছি না তো যেন আরেকজনের ক্ষতির কারণ হয়? বালুতে মুখ গুঁজে রেখে নয়, চোখকান খুলে সবাই নিজের অবস্থান থেকে সচেতনতা বাড়াই। কথা ও কাজে দেখিয়ে দেই- "যদি তুমি আত্মহত্যার কথা ভেবে থাকো, আমরা তোমার সঙ্গে আছি; যদি তুমি লড়াই করো, আমরা তোমার সঙ্গে আছি।" অরিত্রীদের অন্ধকারে আমরা যদি আলো না হই, ওদের তখন আর উপায় কি থাকে, বলুন?
লেখক: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট