১৪ ডিসেম্বর: এক অনন্ত শোকের দিন
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:৫৯
যেবার হুমায়ূন আজাদকে কোপানো হল, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, মনে আছে আমি ডাক ছেড়ে কাঁদছিলাম। আমি কোনভাবেই কান্নাটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। আমার শুধু মনে হচ্ছিল, এত বড় একজন লেখক, যার হাত দিয়ে এরকম অসাধারণ সব কবিতা বেরিয়ে আসে, তাকে কীভাবে মেরে ফেলার উদ্দেশে চাপাতি দিয়ে কোপায়? তিনি যদি মরে যান তাহলে ওরকম সব কবিতা কে লিখবে আর?
মনে আছে, শাহ এম এস কিবরিয়াকে মারা হল। আমি সেবারও কাঁদছিলাম, নিজেকে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, এই জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান বয়স্ক মানুষটিকে কীভাবে হত্যা করতে পারে কেউ? একইসাথে মনে হচ্ছিলো, দেশ এত বড় একজন স্কলারকে হারালো! আমি কোন সান্ত্বনা পাচ্ছিলাম না।
এরপর দেশে বহু অসম্ভব সব অঘটন ঘটে গেছে। অভিজিৎ রায়, ফয়সল আরেফীন দীপনরা ঝরে গেছেন একের পর এক। আমি এই মৃত্যুগুলোকে কোনদিন মেনে নিতে পারিনি। এগুলো তো শুধু একেকটা মানুষের মৃত্যু না, এক একটা প্রতিভা, বিদ্বান মস্তিষ্কের মৃত্যু। এমন এক মৃত্যু যা আমাদেরকে হাজার বছরের অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। এমন এক মৃত্যু কোন ক্ষতিপূরণেই যা থেকে নিষ্কৃতি মেলে না!
৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনে গৌরবের অধ্যায়। একই সাথে এর চেয়ে বড় বীভৎসতার অধ্যায় আমাদের জীবনে আর আসেনি। হয়তো এই পৃথিবীর খুব কম জাতির জীবনে এত বড় বীভৎসতা এসেছে। হত্যা, ধর্ষণ আর লুটপাটের যে আদিভৌতিক চেহারা এই একাত্তরে পাক হানাদাররা দেখিয়েছিল, তার কোন নজির সহজে পাওয়া যায় না। ধর্ষণ তো শুধু ধর্ষণ ছিল না, ছিল বীভৎস বিকৃতির নয় মাস ব্যাপী এক কুৎসিত উৎসব।
আর যদি ভাবি ১৪ই ডিসেম্বরের কথা?
৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী, ২ জন অন্যান্য...
পুরো বাংলাদেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে ধরে বেঁধে নিয়ে আসা এক একটি রত্ন, মণিমাণিক্য- আহা! আমি খুব বেশিদূর ভাবতে পারি না। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পড়ে থাকা লাশের ছবিগুলোর দিকে আমি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। রায়ের বাজার শব্দটা শুনলেই আমার বুক ভারি হয়ে আসে। বধ্যভূমি শুনলে আমার দম বন্ধ হয়ে যেতে চায়!
আমি জানি না একজন জাহিদ, কি শমী কি আসিফ কি একজন নুজহাতের কেমন অনুভূতি হয়, একজন শাওন মাহমুদের কেমন লাগে কিংবা কেমন অনুভূতি হতো সুমন জাহিদের সারাটা জীবন? যে অনুভূতি জুড়ে খুব ছোট্ট বয়সে হারিয়ে ফেলা বাবা অথবা মাকে খুঁজে ফেরার স্মৃতিটুকুই শুধু আছে! আর কিচ্ছু নেই, কিছুই না।
আমি জানি না, আমার বাবা কি মাকে হারিয়ে ফেললে, যুদ্ধে তাদের এমন বীভৎস মৃত্যু হলে, আমার কেমন লাগতো! আমি কি এই শোক মেনে নিতে পারতাম? আমি কি সুস্থ থাকতাম?
আমি জানি না। শুধু জানি, তালিকা তৈরি করে রাতের অন্ধকারে বেছে বেছে নিয়ে যাওয়া আমার দেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান মানুষগুলোর অকাল ভয়ংকর মৃত্যু আমি কোনদিন মেনে নিতে পারি নাই। পারবোও না। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস তাই আমার কাছে এমন এক অন্ধকার, যা কোনদিন কোন আলো দিয়েই আর দূর করা সম্ভব হবে না।
শ্রদ্ধা, শোক, অনন্ত শোক...আর ভালোবাসা আপনাদের জন্য। আপনাদের নাম আমাদের অশ্রুজলে লেখা থাকবে অনন্তকাল।
লেখক: সাংবাদিক