গল্পটা আসলে বিজয়ের

প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ২২:৩৪

কমলা ভাসিন বলেছিলেন - "একজন নারীবাদীর জন্ম সেদিন, যেদিন পিতৃতন্ত্রের উৎপত্তি হয়, তোমার আমার ব্যক্তিগত জীবন না বদলালে পিতৃতন্ত্র চলে যাবে না। সুতরাং আমি নিজের দিকে আঙুল রাখছি, তোমরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিজের দিকে আঙুল রাখ"।

না, কোন রাজপুত্র-রাজকন্যে, রাজা-রাণী, রোমিও-জুলিয়েট এ গল্পে নেই। এ নিখাদ আটপৌড়ে এক নারীর ইচ্ছেপূরণের গল্প। এ গল্পে সম্পর্কের টানাপোড়নের টানটান উত্তেজনা নেই। স্টার জলসার সিরিয়ালের মেলোড্রামাও নেই। গল্পটা অনেক যুগের লড়াইয়ের পর অবশেষে বিজয়ের। 

বলা হয়ে থাকে, নারীর জীবনে নাকি দুটো অধ্যায় - এক বিয়ের আগে, এবং দুই বিয়ের পরের পরাজয়, পরিবর্তন আর মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার অধ্যায়। ক্রমশ সংসারের চক্রব্যুহে আটকে নিজের ইচ্ছে আর স্বপ্নকে মেরে ফেলার অধ্যায়। শ্বশুর বাড়িতে আধহাত ঘোমটা টেনে সকাল সন্ধ্যে হাতা-খুন্তি নাড়তে নাড়তে আর কাকভোরে উঠতে উঠতে কখন যে ওপারের ডাক এসে যায়, তা নাকি মেয়েরা নিজেও বুঝতে পারে না। 

আমাদের গল্পের নারীটির জীবনও এরকম হওয়ার কথা ছিল। নাহ, সে হতেই হবে বলে কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি বটে, কিন্তু দুঃখ আর মানিয়ে নেওয়ার ককটেল বানিয়ে "মহান সতী নারী"র কনসেপ্ট এই উপমহদেশের দর্শক গোগ্রাসে খায়, এটা টিভি সিরিয়ালের দৌলতে আমরা সবাই-ই জানি। যাইহোক, আমাদের গল্পের নারীর জীবন কিছুটা এই গৎবাঁধা নিয়ম থেকে আলাদা। 

জন্মসূত্রে মুসলিম মেয়েটির বাবা-মা ভাগ্যক্রমে (দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য জানি নে, পাঠকগণ আপন মনের মাধুরী মিশায়ে বুঝে নেবেন) কমিউনিস্ট। তার উপর মেয়েদের পড়ানো হয় এই পরিবারে, এবং শুধু পড়ানোই নয়, মেয়েদের আবার সর্বপ্রকার স্বাধীনতাও দেওয়া হয়। এই আস্পর্ধা সমাজ মেনে নেবে যদি ভেবে থাকেন, তবে আপনি রামগোপাল ভার্মার সিনেমা দেখুন গিয়ে, এ গল্প আপনার জন্যে নয়। 

নিজ সমাজে ধর্মহীনতার অপরাধ আর বাকি সমাজ এবং দেশে 'সংখ্যালঘু' হওয়ার অপরাধবোধ নিয়ে বাড়তে থাকে আমাদের গল্পের মেয়েটি। লড়াই, লড়াই আর লড়াই। এই যেন আজন্ম রুটিন। এইসবের মধ্য দিয়েই এম.এস.সি করা, নিজের ইন্সটিটিউট খোলা। তারপর বিয়ে। 

এবারে বিয়ে যার সাথে হল, সে আবার এক আজব মানুষ। সে কিনা সমতা এবং নারী অধিকারে বিশ্বাসী এক পুরুষ। সে কিনা রান্না করা থেকে ঘর পরিষ্কার, সবই সমান রুটিনে ভাগ করে নেয়! সুতরাং বিয়ের পর মেয়েটির নাম বদলের, কুর্তা-জিন্স-চুড়িদার পালটে শাড়ী পরার, হিজাব মাথায় উঠানোর, সকাল সন্ধ্যে হাঁড়ি ঠেলার -কোনো চাপই শ্বশুর বাড়ি থেকে পড়লো না। সপ্তাহকে সমানভাবে বাবার বাড়ি এবং শ্বশুর বাড়ি থাকার রুটিনে ভাগ করলো মেয়েটি, কারনটা তার কাজের ক্ষেত্র এবং বাবার বাড়ির দায়িত্ব। এবারে কাজের চাপে সেই ভাগ গেল পাল্টে। বাবার বাড়ি বেশি ভাগে এবং শ্বশুর বাড়ি এসে ঠেকলো সপ্তাহের কম ভাগে। এবারেও কোনো চাপ বা আপত্তি উঠলো না। বরং এবারে স্বামীটিও সপ্তাহের সাতদিন ভাগ করে নিল দুই বাড়িকে সময় দিতে। 

আমাদের মেয়েটি তার বাবার কথায় এবং নিজের ইচ্ছেপূরণে আইন বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল। এবারে শ্বশুর-শাশুড়ি স্বামীর থেকেও এককদম বেশি। বলেন কিনা, রান্নাঘরে যেতে হবে না তুমি পড়তে বসো! কি অদ্ভুত ভাবুন তো! পরীক্ষার আগের রাতে শাশুড়িও বেশি রাত করে ঘুমোচ্ছেন বৌমাকে চা বানিয়ে দিয়ে! পড়ার টেবিল, চেয়ার বানিয়ে দিচ্ছেন যাতে বৌমার পড়তে অসুবিধে না হয়! আরো অদ্ভুত তাই না? সিরিয়াল, সিনেমায় যেখানে দেখায় শাশুড়ি মানেই খুন্তি হাতে দজ্জাল এক মহিলা, যিনি কিনা কথায় কথায় বৌমা নামক প্রাণীটিকে অকথ্য অত্যাচার করে চলেন, আর বৌমা চোখের জলে, নাকের জলে সমুদ্দুর বানিয়ে ফেলে, সেখানে এই শাশুড়ি কি না স্বপ্ন দেখেন তার বৌমা জজ হবে! কি অদ্ভুত চরিত্র! লালমোহন বাবুর ভাষায় বলতে গেলে "হাইলি সাসপিশিয়াস"! 

এবারে আমাদের গল্পের মেয়েটিরও এই বিশ্বাস এবং ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার কথা ছিল! এবং গল্পের শেষাংশ তা দাবীও করে। ওই যে শাহরুখ খানের 'ওম শান্তি ওম' সিনেমার "হ্যাপিওয়ালা এন্ডিং" ডায়লগ। মনে আছে তো? যাইহোক পরীক্ষার ফলপ্রকাশের পর দেখা গেল রেকর্ড মার্ক পেয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে 'টপার' হয়েছে। গত পনেরো বছরে নাকি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে কেউ এতটা নম্বর পায় নি! মেয়েটি খুশি। তারচেয়েও খুশি দুই বাড়ির সবাই। 

এবারে উপসংহারে বলতেই পারতাম "আমার কথাটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো।" আপনাদেরও সুযোগ থাকতো "কেন রে নটে মুড়োলি" ইত্যাদি প্রভৃতি বলার। কিন্তু আমার আরো কিছু কথা আছে। এতক্ষণের গল্পের মেয়েটি আমার দিদি। কিন্তু দিদির সাফল্যে গর্বিত হয়ে এতটা লিখবো ভেবে লিখিনি। উদ্দেশ্যও ছিল না। বরং একজন নারী হিসেবে আরেকজন অনন্য নারীকে স্যালুট জানাতে এতটা বলতে চাওয়া। যে নারীটি কিনা দেখিয়ে দিলেন, একজন নারী চাইলে যে কোন সময়, যে কোন অবস্থায় নিজের স্বপ্নকে সফল করে তুলতে পারে, দরকার শুধু সাহস, ইচ্ছেশক্তি আর আত্মবিশ্বাসের।

যে মেয়েরা নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারোনি পরিবার, সমাজের চাপে বিয়ের পিঁড়িতে বসে, নিজের ক্যারিয়ার ছেড়েছো, তারা প্লিজ বুঝতে শিখো বিয়ে করা মানেই নিজের সব ইচ্ছা-আকাঙ্খাকে বিসর্জন দিয়ে সন্তান প্রতিপালন করা নয়। এবং বিয়ে একজন নারীর জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতাও নয়। জীবনের সব ক্ষেত্রে, সব পর্যায়ে এগিয়ে যেতে গেলে শুধু একটাই মন্ত্র নারীর আওড়ানো দরকার - "নিজেকে বদল করো"। নিজের ভিতরের পিতৃতান্ত্রিক যে নিয়মগুলো নারী যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে, সেগুলো বদল করা। নারীকে বুঝতে হবে সে দুর্বল, অসহায় বা পরনির্ভর, স্বামীনির্ভর কোনো গৃহপালিত প্রাণী নয়। সে সব করতে পারে যদি সে চায়। এবং সর্বোপরি তাকে বুঝতে হবে তার জীবনের সবথেকে বড় প্রতিবন্ধতা কোনো পুরুষ, সমাজ বা দেশ নয়, সে নিজে। তার চিন্তা। আর সবকিছু মেনে নেওয়ার এবং মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা। 

শুধু নারীকেই নয়, পুরুষকেও বুঝতে হবে, বিয়ে মানেই আরেকজন মানুষকে নিয়ন্ত্রন করা নয়, নিজের অধীনে আনাও নয়। বরং একসাথে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বপ্ন, ইচ্ছেগুলো পূরণ করা। পুরুষকে অবশ্যই বুঝতে হবে নারী নিজের জীবনে কি করবে, কি পরবে, কি খাবে, উচ্চশিক্ষা লাভ করবে নাকি চাকরি করবে - সেটা ঠিক করে দেওয়ার তার অধিকার বা এখতিয়ারই আসলে নেই। কারন তার বউ অথবা যে কোন নারীই জন্মগতভাবে এই অধিকারগুলো নিয়েই পৃথিবীতে এসেছে। 

পুরুষ নারীর কর্তা সাজার ভূমিকা ছাড়ুক এবং নারী নিজের অধিকার বুঝতে শিখুক, চিন্তা চেতনা বদলাক, তবেই হয়তো একদিন সমতার পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব। সমাজের ঘরে ঘরে সাবিনারা, রুহুলরা ছড়িয়ে পড়ুক, বেড়ে উঠুক - এই আশাই করতে পারি এই চুড়ান্ত অসমতার পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে, এই মুহুর্তে।

লেখক: শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত