নারীকে কবে আমরা মানুষ ভাববো?
প্রকাশ : ২৭ মে ২০১৮, ০০:৪৫
‘ধর্ষণ’ নারীর ওপর পুরুষের বলপ্রয়োগের চুড়ান্ত রূপ। একজন মানুষকে কীটপতঙ্গেরও মর্যাদা না দেবার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ধর্ষণ। তার ইচ্ছে অনিচ্ছের তোয়াক্কা না করে তার উপর নিজের পৌরুষিক ক্ষমতা দেখানোর বিকৃত রূপ হচ্ছে ধর্ষণ।
ধর্ষণ বর্তমান সময়েই যে শুধু হচ্ছে তা কিন্তু নয়। প্রাচীন কাল থেকেই তা চলে আসছে, সে গ্রীক পুরাণই হোক বা উপাখ্যান, দেবতা হোক বা নবী। মানব সভ্যতার ইতিহাস ধর্ষণের ইতিহাস লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। বরং বিভিন্ন প্রাচীন উপাখ্যানে ধর্ষণকে অনেকটা ধর্ম এবং দর্শনের মোড়কে দেখানো হয়েছে। গ্রীক পুরাণ জুড়ে দেখা যায় নারীর শরীর পুরুষের কাম প্রশমিত করার বস্তু। তাকে আক্রমন করা যায়, লুট করা যায়, যদি না তার আক্রমনকারীকে প্রতিহত করার কোনো চরম উপায় না থাকে। সেই উপায়টি কি? উপায়টি হচ্ছে নারীর স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ। মৃত্যুই বাঁচাতে পারে নারীর সম্ভ্রম! এইকথাটি যে শুধু গ্রীক পুরাণেই সীমাবদ্ধ তা তো নয়! আমরা এই প্রাচীন ভারতবর্ষেও দেখেছি "জৌহর"। আলাউদ্দিন খিলজীর কামনার হাত থেকে বাঁচতে পদ্মাবতী তার সহচরীদের নিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন। এবং ভারতীয় সমাজে তা নারীর সতীত্বের বিজয়গাঁথা হিসেবে আজোও পালিত হয়ে আসছে!
আমাদের ইতিহাসটার দিকে একবার তাকান- স্বামীর অপমান হলে রাজসভায় প্রাণ দেওয়ার নাম সতীত্ব। স্বামী মরলে তার সাথে সহমরণে যাওয়ার নাম সতীত্ব। কি মর্মান্তিক! শুধু যে প্রাচীন উপাখ্যান- তাও তো নয়! আমাদের সিনেমাগুলোতেও কি দেখছি আমরা? নায়িকা ভিলেনের লালসার শিকার হয়ে নিজেকে বাঁচাতে বুকে ছুরি তুলে বলছেন "জান দেবো, তবু ইজ্জত দেবো না"! মানে ঘরে ঘরে আমাদের মেয়ে এবং ছেলেদেরও বুঝিয়ে তোলা হচ্ছে- নারীর প্রাণের মূল্যের চেয়েও ইজ্জতের মূল্য বেশী! নারীর শরীর শেষ মানে নারীর জীবন শেষ!
যাই হোক, পৌরাণিক ধর্ষণের ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, তা প্রমাণ করে ধর্ষণের ইতিহাস মানব সৃষ্টির ইতিহাসের সমসাময়িক। ব্রাউনমিলার বলেছিলেন, "শুরুতে পুরুষ ছিলো প্রাকৃতিক লুন্ঠনকারী আর নারী ছিলো প্রাকৃতিক শিকার"।
পৃথিবীতে নারী জন্মের শুরু থেকেই এই অমানবিক আক্রমণ/হিংসাটি বা হিংসার সম্ভাবনাটি প্রত্যেক নারী শিশু অবস্থা থেকে প্রৌঢ় পর্যন্ত বয়ে বেড়ান। নিজের বাড়ি থেকে শুরু করে স্কুল/লিফ্ট/বাজার/অফিস/থানা - সর্বত্র, এর কোনো নির্দিষ্ট স্থান, সমাজ, দেশ নেই। ভারতবর্ষে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে একজন নারী ধর্ষণের ভয় থেকে মুক্ত। ধর্ষণ সবচেয়ে বিকশিত এক সামাজিক কর্মকান্ড এই দেশে, সারা পৃথিবীতে যার কোনো তুলনা মেলে না! এখানে একক ধর্ষণ হয়, দলবদ্ধ ধর্ষণ হয়, এবং ধর্ষণের পর খুব ঠান্ডা মাথায়, সুচারুভাবে খুন করা হয়। এখানে বাবা ধর্ষণ করে মেয়েকে, শ্বশুর ধর্ষণ করে বৌমাকে, ছাত্র ধর্ষণ করে শিক্ষিকাকে, শিক্ষক ধর্ষণ করে ছাত্রীকে, দেবর ধর্ষণ করে বৌদিকে, পুলিশ ইন্টারোগেশনের নামে ধর্ষণ করে লক আপে ঢুকিয়ে, আর্মি উগ্রপন্থী ধরার নামে ধর্ষণ করে ভ্যাজিনাতে গুলি করে.....। ভারতবর্ষ আজ ধর্ষকদের চারণভূমি। মেয়েটি স্কুলে/অফিসে/বাজারে যাবে- সে আর কিচ্ছুর ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের। চাষী বউ মাঠে যাবে, সে আর কিচ্ছুর ভয় পাচ্ছে না, পাচ্ছে ধর্ষণের। আশাকর্মী মেয়েটি রাতে গর্ভবতী রোগীর বাড়ি যাবে, সে আর কিচ্ছুর ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের। সুজান গ্রিফিন বলেছিলেন "আমি কখনোই ধর্ষণের ভয় থেকে মুক্ত থাকতে পারিনি"। আজকের ভারতবর্ষের প্রতিটা মেয়ে সুজান গ্রিফিন।
ভারতীয় সমাজে নারী ধর্ষিত হয়েও দোষী। তার মাথা থেকে পা অব্দি প্রত্যেকটা অঙ্গের, তার পরিধান করা পোশাকের, তার চরিত্রের চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। সে কেন ছোটো জামা পরেছে, সে কেন বুক দেখিয়ে হেঁটেছে, সে কেন এত রাতে বাইরে বেরিয়েছে, সে কেন ছেলে বন্ধুর সাথে বেড়াতে গেছে! ভদ্রলোকেরা এবং ভদ্রমহিলারা উসখুস করে উঠবেন। মেয়েটি নিশ্চয় খারাপ। স্বভাব চরিত্র খারাপ। অসতী। খুব অসতী মেয়ে। ধর্ষণ তো হবেই। এখানে বলে রাখা ভালো, পাশ্চাত্য দেশেও ধর্ষণ হয়, ধরা পড়লে শাস্তিও হয়। কিন্তু সেখানে ধর্ষিতাকে কেউ পোশাক নিয়ে প্রশ্ন করে না, তার চরিত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে না। এবং হ্যাঁ এটাই পাশ্চাত্যের সাথে ভারতবর্ষের তফাত।
শুধু সমাজও তো নয়। আমাদের আইনি ব্যবস্থাও একই রকম। নারী শুধু ধর্ষিত হলেই চলবে না, তার শরীরে থাকতে হবে মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন। তার যোনী থাকতে হবে ক্ষতবিক্ষত। আঘাতের চিহ্ন যত গভীর হবে ততো ভালো। বিচার ব্যবস্থা জানতে চাইবে মেয়েটির কাছে, সে কি একটুও সুখ পেয়েছে? তাহলে চলবে না। এখানে মনে করিয়ে দিতে চাই, এই কদিন আগেও একটা মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে কি না তার জন্য হতো "টু-ফিঙ্গার টেস্ট"। মানে ডাক্তারবাবু হাতের দুই আঙ্গুল মেয়েটির যোনীতে প্রবেশ করিয়ে বুঝতে চাইতেন মেয়েটি আদৌ ধর্ষিত হয়েছে কিনা!! অনেক আন্দোলনের পর এই অমানবিক টেস্ট সিস্টেম বাতিল করানো হয়েছে। আদালত কক্ষে বারবার তার কাছে জানতে চাওয়া হবে, তার সঙ্গমের অভিজ্ঞতা আছে কি না! থাকলে সেটা কেমন? সে এর আগে কার কার সাথে সঙ্গম করেছে? সঙ্গমে সে সুখ পায় কি না? উকিলবাবু বারবার জোর দিয়ে জানতে চাইবেন, ধর্ষণ কখন হয়েছে? কিভাবে করেছে? ওড়নাটা কিভাবে খুলেছে? ব্রা টা খুলেছে নাকি ছিঁড়েছে? কতক্ষণ করেছে? মেয়েটি দু-পা চেপে ধরেছিলো নাকি ধরেনি? বিরতিহীন লাগামহীন প্রশ্ন চলতেই থাকে। এবং আদালত কক্ষে মেয়েটি পুনরায় ধর্ষিত হয়। আরেকটা মজার কথা হলো, আমাদের বিচারব্যবস্থা বৈবাহিক ধর্ষণকে স্বীকৃতিই দেয় না! বৈবাহিক ধর্ষণে আমাদের দেশ পৃথিবীর মধ্যে এগিয়ে, কিন্তু সেই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের আইনেই, শুধু বৈবাহিক ধর্ষণের কোনো নির্দিষ্ট আইন নাই!
ক'দিন আগে কয়েকজন নারীর সাথে ধর্ষণ রোধে পারিবারিক ভূমিকা কি হতে পারে সেটা নিয়ে কথা বলছিলাম। বলছিলাম "প্রতিটা ঘরে ঘরে যদি বাবা-মা'রা নিজের সন্তানদের শেখান পোশাকের সঙ্গে চরিত্রের কোনো সম্পর্ক নেই, মানুষকে পোশাক দিয়ে বিচার না করে বরং তার চিন্তা, মেধা, মনন দিয়ে বিচার করা উচিত। কেউ ছোটো পোশাক পরলেই তার সাথে খারাপ আচরণ করার অধিকার কারোর নেই। তাকে যদি শেখানো হয়, কারোর (নারী হোক বা পুরুষ) ইচ্ছের বিরুদ্ধে, মতের বিরুদ্ধে তাকে ছোঁয়া অন্যায়, অপরাধ, প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাদের যদি শেখানো হয় কারো অধিকার নেই কাউকে ধর্ষণ করবার। এবং স্ত্রী বা প্রেমিকার সাথেও যদি তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, সেটাও ধর্ষণ।" - তারা শুনে বলেছিলো, তোমার এই কথাগুলো বেশীরভাগ মেয়েরাই বুঝতে চাইবে না!
এটাই তো আক্ষেপ আমার। সমাজের বেশীরভাগ নারীর মধ্যেই ঘাপটি গেঁড়ে বসে পুরুষতান্ত্রিকতা। উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত নারীদের মধ্যে আরো বেশী বেশী করে আছে। তারা বুঝতেই চায় না বা পারে না, স্বামীরাও যে ধর্ষণ করতে পারে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিছানায় টেনে নিয়ে যাওয়াও যে ধর্ষণ, সেটা উচ্চশিক্ষিত নারীরাও বুঝতে পারে না। পিরিয়ড চলাকালীনও শুধু স্বামীর ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকার করে দাঁতে দাঁত চেপে সঙ্গমে সায় দিয়ে যাওয়াও যে ধর্ষণ, সেটা তারা বুঝে না। ক্ষেত্রবিশেষে বুঝলেও মানতে চায় না। এই বুঝি সুখের সংসারের ঠুনকো দেয়াল ভেঙ্গে পড়লো, সেই ভয়ে!
অনেক সময় আশ্চর্য হই, আমরা হিন্দু বুঝি, মুসলমান বুঝি, রাজনীতি বুঝি, সায়েন্স বুঝি, শিল্প বুঝি, আইসিস বুঝি, জেহাদী বুঝি, মহাকাশ পৃথিবী গ্রহ নক্ষত্র চাঁদ তারা সূর্য টেকনোলজি, সাহিত্য - সব বুঝি। শুধু বুঝি না নারীর পূর্ণাঙ্গ মানুষের অধিকার। জ্বীন, ভূত, ভগবান, আল্লা, ঠাকুর, জেসাস, গুরু, সন্ন্যাসী, পীর- সবেতে বিশ্বাস করি আমরা। শুধু বিশ্বাস করি না নারীও মানুষ এবং মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে তার সমঅধিকার। নারীর মানুষ হিসেবে প্রাপ্য অধিকার/সম্মানের ক্ষেত্রে আমরা চূড়ান্ত নীরবতা পালন করে চলি।
"হে ভারত, ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দয়মন্তী"- আর আমিও বলতে চাই এই আদর্শের ষোলো আনাই হলো নারীকে নির্বোধ, মূক পশু করে রাখার আদর্শ। তাই এটা ভুললে চলবে না। কারন এই কথাটা ভুলে গেলে নারীর পরাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাসকে ভুলে থাকা হবে!!
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট