সুফিয়া কামাল হল প্রসঙ্গ
প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০১৮, ২১:৫৮
ক্ষমতা 'সত্য' নির্মাণ করে। এই কথাটি বেশিরভাগ মানুষের কাছে স্রেফ তত্ত্বকথা হিসেবে পরিচিত হলেও গত কয়েকদিন ধরে এই তত্ত্বকথাটির তাৎপর্য আমরা নতুন করে অনুধাবন করছি কোটা সংস্কার আন্দোলন ও আন্দোলনকে ঘিরে সরকার সমর্থক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের প্রপাগান্ডার কারণে। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং ভয়াবহ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেল সুফিয়া কামাল হলে ১১ এপ্রিল রাতে সংঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী এশাকে 'ভিক্টিম' হিসেবে উপস্থাপনের প্রক্রিয়ায়। একজন সন্ত্রাসী, যে কিনা দিনের পর আবাসিক হলে কাঠামোগত সন্ত্রাস চালানোয় নেতৃত্ব দিয়ে আসছে, যার নির্মম বর্ণনা আমরা বিভিন্ন ভুক্তভোগীর বয়ানে জানতে পেরেছি; তার জন্য আমাদের কোন সাহিত্যিকের হয়তো 'মাথা হেঁট' হয়ে গেছে, কোন সাংবাদিক হ্যাশট্যাগ দিতে দিতে ব্যাকুল, কোন সাংবাদিক আরেকপ্রস্থ এগিয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা এশাকে ফুলের মালা পরানোর ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কে জানে এশার মত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধকে তারা নিজেদের পরাজয় ভাবেন কিনা! হলে ও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ বছরের পর বছর যে কাঠামোগত সন্ত্রাস অব্যাহত রেখেছে তার নিরসনকল্পে জনমত গঠন করায় এইসব সাংবাদিক সাহিত্যিকরা উদ্যোগী না হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এই কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য থাকবো।
এরমধ্যে সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী আফরিন নুসরাতের একটা লেখা ছাপা হলো, যেখানে তিনি দাবি করেছেন এশাকে তার রুম থেকে মারতে মারতে, চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে বাইরে আনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। একজন সন্ত্রাসীকে 'ভিক্টিম' হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য মোক্ষম কৌশল বটে! এশাকে গলায় জুতো পড়ানোর যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, তার আগে এশাকে করিডোর থেকে হলের মাঠে নিয়ে আসা পর্যন্ত তিনটি ভিডিও আমি দেখেছি। প্রয়োজন হলে সেগুলো আপলোড করতে আমি বাধ্য হবো।
এশার সংগঠনের লোকজন অনলাইনে যে কায়দায় প্রতিরোধে অংশ নেয়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে 'জিহাদ' ঘোষণা করেছে, যেভাবে হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছে, যেভাবে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এশাকে 'সম্মানিত' করার কথা বলেছেন; তাতে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের বীর সাধারণ শিক্ষার্থীরা চরম উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এশাকে হলের মাঠে নিয়ে আসা পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের ভিডিও তাদের হাতে থাকার পরেও তারা ভয়ে সেগুলো প্রকাশ করতে পারছে না। কারণ ইতোমধ্যেই তাদেরকে হল থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। এই মেয়েরা জানে তাদের উপর সম্ভাব্য কোন জুলুম নিপীড়নেই কোন 'প্রথিতযশা' সাংবাদিক এগিয়ে আসেননি আগেও এবং ভবিষ্যতেও আসবেন না। তারা দ্বিতীয়বার রিস্ক নেবেন কিসের ভরসায়?
তিনটা ভিডিও আমি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে দেখেছি। মেয়েদের এই অভূতপূর্ব ডিসিপ্লিনে আমি সত্যিই মুগ্ধ। দিনের পর দিন যার শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে তারা কিংবা তাদের বন্ধুরা, তাকে রীতিমত দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে হাতে হাত রেখে এস্কর্ট করে হলের মাঠে নিয়ে গিয়েছে। এই ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন যিনি, সেই ক্রিকেট খেলুড়ে অন্তী সহ বাকিরা বারবার তারস্বরে চিৎকার করে বলছেন, "আপুরা কেউ গায়ে হাত দিবেন না প্লিজ", "আপুরা আপনারা সবাই শান্ত থাকবেন.." এবং সত্যি সত্যিই দলবেঁধে এস্কর্ট করে এশাকে তারা হলের মাঠে নিয়ে গেছেন। হলের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মেয়েরা 'শেইম, শেইম', 'বহিস্কার, বহিস্কার' স্লোগানে প্রকম্পিত করেছে পুরো হল। একজন সন্ত্রাসীর সাথে এর চেয়ে ভদ্রোচিত, এর চেয়ে ডিসেন্ট প্রতিবাদ প্রতিরোধ আর কী হতে পারে?
মাঠের নেয়ার পরেও কিন্তু এশার হম্বিতম্বি একটুও কমেনি। সে বরং রুমে ফেরত যেতে চাইছিল, উলটো মেয়েদের কাউকে কাউকে চিৎকার করে বলতে শুনেছি, "না না তাকে যেতে দিবেন না..", "বিচার চাই বিচার চাই.."। এই ঘটনার পরে সবচেয়ে বেশি হুমকিতে আছেন যিনি, ক্রিকেটার অন্তী, তিনি হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে মেয়েদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন, "আপুরা সবাই একটু চুপ করি..", "আপুরা আমরা সবাই বসে পড়ি.."।
এশা সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে, যখন সে বুঝতে পেরেছে তাকে জুতোর মালা পরানো হবেই। হাজার হোক সে ছাত্রলীগের দুর্ধর্ষ ক্যাডার, সুফিয়া কামাল হলের ত্রাস, তাকে কোনদিন এই পরিণতি ভোগ করতে হবে তা তো সে কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি, যেমন ভাবতে পারেনি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের প্রতি সীমাহীন অনুরক্ত অনেক 'প্রগতিশীল' লোকজনও।
হলের মেয়েরা নাকি এশার জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলেছে, এশাকে এমন মার মেরেছে যে এশার শরীরে চাকা চাকা রক্ত। এগুলো যে কতটা মিথ্যা তা সবচেয়ে ভালো জানে এশা নিজে এবং আফরিন নুসরাত। ধস্তাধস্তির সময় এশার ওড়না খুলে গিয়েছিল, হলের মেয়েরাই তাকে ওড়না এগিয়ে দিয়েছে। যেহেতু তারা ছাত্রলীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধারণ করেন না, কারোর জামাকাপড় ছেঁড়া, কাউকে মারধর করা তাদের স্বভাবে নেই। অন্যকে বিবস্ত্র করায় বরং এশা শায়লারা কতটা সিদ্ধহস্ত তা আমরা গত জানুয়ারি মাসের নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের সময় দেখেছি। এশা শায়লাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সুপষ্ট স্থিরচিত্র, ভিডিও থাকার পরেও সেই সময়ে আজকের অনেক 'মানবতাবাদী' সাংবাদিকরা চুপ ছিলেন, এশা শায়লাদের শাস্তির দাবি জানাননি। শায়লা তো রীতিমত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভারত সফর করে এসেছে। এর প্রতিবাদ স্বরূপ তখন কোন সাংবাদিক এক লাইন হ্যাশট্যাগও খরচ করেননি।
এইভাবে শুধুমাত্র দলীয় আশ্রয় প্রশ্রয়ই পায়নি এশা শায়লারা; দলের বাইরেও ছদ্ম 'নিরপেক্ষ' বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-লেখক-সাহিত্যিকদের প্রচ্ছন্ন আস্কারাও পেয়েছে দিনের পর দিন। ফলশ্রুতিতে এশা শায়লারা হয়ে উঠেছে দুর্দমনীয় দানব।
লেখাটি যারা এ পর্যন্ত পড়েছেন, ঢাবিসহ সকল ক্যাম্পাসে চলমান কাঠামোগত সন্ত্রাস বন্ধ করতে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। যে মেয়েরা অভূতপূর্ব প্রতিরোধের সূচনা করেছে, যে ছেলেরা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ধাওয়া দিতে পেরেছে ক্যাম্পাসে, তারা যেন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন মুক্ত ক্যাম্পাসে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে সেই লক্ষ্যে আমরা আওয়াজ তুলতে পারি। সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে প্রাতিষ্ঠানিক সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা যে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়তে বাধ্য তার অজস্র প্রমাণ আমাদের হাতের কাছেই আছে। প্রয়োজন কেবল নিজেদের প্রতিরোধের শক্তি সম্পর্কে আস্থা রাখতে পারা।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট