পরিবার ভাঙার দায় নারীবাদের নয়, পুরুষতন্ত্রের
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০১৮, ১৮:৪২
নারীবাদ নিয়ে পুরুষতন্ত্রের ভয়ঙ্কর অপপ্রচারগুলোর একটি হলো, নারীবাদ নাকি পরিবার প্রথা ভেঙ্গে দিতে চায়। কিন্তু নারীবাদের ভিন্ন ভিন্ন ওয়েভে বিকল্প পরিবারের বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আজকের নারীবাদ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে প্রথাগত পরিবারের ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি পরিবারের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করে। আজকের নারীবাদ পরিবার ভাঙ্গতে চায় না মোটেও, বরং দ্বন্দ্ব ও অসাম্যে পরিপূর্ণ পরিবারগুলোর উপর থেকে মিথ্যা শান্তির চাদর সরিয়ে সত্যিকারের সুখ শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
নারীবাদ আজকে যৌক্তিক বিশ্লেষণ করে দেখাতে পেরেছে, অসম পরিবারে শান্তি থাকে না বরং একজনের শান্তি অন্যজনের অশান্তির কারণ হয়। একটি মেয়ে যদি তার নিজের জীবন নিয়ে নিজস্ব স্বপ্ন ও লক্ষ্য স্থির করে, গার্হস্থ্য কাজের বিনা মজুরির অস্বীকৃত শ্রমের মধ্যে আটকে না থেকে নিজের শিক্ষা আর যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে চায়, নিজের জীবনের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ চায়, কিন্তু তার পরিবার ও স্বামী তা দিতে অস্বীকার করে তখন ঘরের শান্তি নষ্ট করার দোষ আসলে কার?
নারীবাদ আজকে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, বেশীর ভাগ পরিবারেই ‘শান্তিপূর্ণতা’ হচ্ছে সামনের ছবি, যার পেছনে অনেক নারীর অনুভূতি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আবেগ আর স্বপ্নের ভাঙ্গা টুকরো ছড়ানো থাকে। নারীবাদ সেই ভাঙ্গা টুকরোগুলোকে এক সুতোয় গেঁথে একটি ন্যায্যতার, সমতার, সম্মানের পরিবার গড়তে চায়।
সুতরাং নিজের মুখোমুখি বসতে হবে এখন পুরুষদের। স্বীকার করতে হবে, নারীর সমৃদ্ধ কর্মজগতের সমান সুবিধাভোগি তারাও। না, শুধু টাকার জন্য নয়। সমতার সম্মানের জন্য। পুরুষদের এই সত্য মেনে নেয়ার সময় এসেছে যে, নারীদের দমিয়ে রেখে সংসারের শান্তি ও সামঞ্জস্য আর রক্ষা করা যাবে না। কারন, নারীরা এখন নিজের অধিকার সম্পর্কে অনেক বেশী সচেতন। তারা পুরুষের অধিপত্যকামি আচরণকে প্রত্যাখ্যান করছে, নিজেদের উপর পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করছে। ঘর সংসার, যৌনদাসত্ব আর বাচ্চা পালনের একপেশে দায়িত্বের মধ্যে আটকে থাকতে চাইছে না।
ঘরের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এখন পুরুষকেই পরিবর্তিত হতে হবে, নারীর কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতাকে মেনে নিতে হবে, সমমর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে এবং তা শুরু করতে হবে পরিবারের ভেতর থেকেই। স্বদেশী বিপ্লব সফল করার জন্য নাকি একটা কৌশল নেওয়া হয়েছিলো রান্নাঘরে বিপ্লবের বীজমন্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া। আর লিঙ্গ সাম্যের বিপ্লব তো রান্নঘরেই শুরু। একদিন এখান থেকেই সাম্য আসবে। প্রতিটি সচেতন মেয়েই পুরুষতন্ত্রের লক্ষণরেখা ডিঙ্গিয়ে একদিন না একদিন শামিল হবেন সমমর্যাদা আর ন্যায্যতার লড়াইয়ে।
আর যদি তা কোনদিনই না হয়? তাহলে আর রোধ করা যাবে না পারিবারিক অসাম্য আর অ-সুখ। পুরুষের দমন নিপীড়নের পরিবার ভেঙ্গে বেরিয়ে আসবে মেয়েরা। মেয়েরা যখন বুঝতে শিখেছে, লড়াই করছে অসাম্য আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে, নিজের অধিকারের কথা উচ্চারণ করছে উচ্চকন্ঠে, তখন ফায়সালা তো একটা হবেই। হয় সমতা ও ন্যয্যতা আসবে নয়তো পারিবারিক অশান্তি আর ঝুঁকিপুর্ণ সম্পর্ক আর হিংসা আর দ্বন্দ্বে বিপন্ন হবে পরিবার।
আজকের পুরুষরা যদি পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান ধারনা আর প্রত্যাশাকে পরিবর্তন করতে না পারেন, যদি নারীকে তার ন্যায্য অধিকার ও প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে অস্বীকার করেন তাহলে পরিবারে যে ঝড় উঠবে তার দায়িত্ব কোনভাবেই নারীবাদের বা নারীর নয়, সেই দায় ওই আগ্রাসী পুরুষতন্ত্রের এবং তার বাহক পুরুষের।
পরিবার থেকেই যেহেতু সব ধরনের বৈষম্যের শুরু, তাই সাম্য না এলে, ন্যায্যতা নিশ্চিত না হলে প্রথম কোপটা পরিবারের উপরই পড়বে। তার জন্য দায়ী থাকবে আগ্রাসী, নিয়ন্ত্রণকামী, আধিপত্যবাদী পুরুষরা। নারীবাদ কোনভাবেই নয়।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ