ব্যাধিটার নাম পুরুষতন্ত্র

প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০১৮, ১২:৫৭

(১)
ফার্স্ট অফিসার মেয়েটার নাম ছিল পৃথুলা। নামটা শুনে প্রথমে একটু অবাক হয়েছি। আসলেই! বাবা মা ওদের মেয়ের নাম রেখেছে পৃথুলা! ছোট এই মেয়েটার এইরকম অকাল মৃত্যুতে যে শোক সেই সাথে কৌতূহলও জুড়ে ছিল মনে- আহারে, কে এই মেয়েটার হতভাগা বাবা, কে ওর মা! না জানি কি অবস্থা মেয়েটার বাবা মায়ের! আজ দুপুরে এক সহকর্মী জানালেন পাইলট পৃথুলা রশিদ ওর বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা। ওর মায়ের নাকি খুব ইচ্ছে ছিল পাইলট হবেন, তিনি নিজে সেটা হতে পারেননি। অনেক শখ করে মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সাথে সাথে ফ্লাইং ক্লাবেও পাঠিয়েছেন। মেয়েটি নিজের দক্ষতা যোগ্যতায় কষ্ট করে ফ্লাইং শিখেছে, পরীক্ষা দিয়ে প্রথমে প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স পেয়েছে। প্রাথমিক লাইসেন্স পাওয়ার পরে নির্ধারিত উড়াল-ঘণ্টা পূর্ণ করেছে, প্লেন নিয়ে উড়েছে আকাশে হাজার ঘণ্টা, পরীক্ষা দিয়েছে, তারপর গিয়ে কমার্শিয়াল লাইসেন্স পেয়েছে। কমার্শিয়াল লাইসেন্স পাওয়ার পরেও তাকে ট্রেইনিং নিতে হয়েছে এরপর গিয়ে কোপাইলট হিসাবে ওড়ার যোগ্যতা পেয়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে বেশ কিছুদিন ধরে ফ্লাই করেছে পৃথুলা। এই বিমানটিও চালিয়েছে, এই বিমানটি চালানোর জন্যেই বিশেষভাবে ট্রেইনিং নিতে হয়েছে তাকে। গতকালের ফ্লাইটটিই ছিল সম্ভবত ওর প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লাইট।

আর সেই মা জননীটি? সেই মা, যিনি তার নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ হতে দেখতে চেয়েছে নিজের কন্যার জীবনে- সেই জননীটি গুরুতর অসুস্থ্য। মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি নাকি ভেঙে পড়েছেন। নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল গতকাল মায়ের। বাবাটি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না, কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেছে। আমি অনলাইনে মেয়েটির ফটো দেখি। রলিপলি ধরনের আদুরে চেহারার ছোট মেয়েটি- জ্বলজ্বলে দুই চোখ জুড়ে স্বপ্ন চকচক করছে। পরনে পাইলটের ইউনিফর্ম- কালো ট্রাউজার, সাদা শার্ট, বুকে লাগানো উইং। আহা, কেবল সেই বাবা মায়ের কথা মনে আসে, চমকে চমকে উঠি- প্রায়নিরাময়অযোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত সেই মা, মেয়েটি যখন এইরকম পাইলটের ইউনিফর্ম পরে ঘর থেকে বের হতো কি অহংকারটাই না জানি হতো মায়ের! আর বাবার! আমি কল্পনা করি আমার নিজের দুই কন্যার কোন একজনকে এইরকম দেখতে কিরকম লাগতো? না, পাইলট পেশার প্রতি আমার সেরকম আকর্ষণ নেই। ধরেন আমার মেয়ে যদি ঐরকম কলার ব্যান্ড ব্ল্যাক জ্যাকেট রোব এইসব পরে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করতে যায়, কিরকম লাগতো দেখতে আমার! বুক ভেঙে আসে, চোখ ভেসে যায় সেই মায়ের কথা সেই বাবার কথা ভেবে।

মামনি কতবার বলেছেন, ছেলেমেয়ে কি জিনিস, বুঝবি যখন নিজের বাচ্চা হবে। আহা, মায়ের ঐসব আহ্লাদ ইত্যাদিতে কত বিরক্ত হয়েছি একসময়। এখন আমার নিজের বাচ্চারা বড় হয়েছে- আসলে বড় তো হয়েছি আমি- আমি জানি বাচ্চাকাচ্চা কি জিনিস!

(২)
ফেসবুকে ফিরতে পেরেছি আজ বিকেলে। ফেসবুক জুড়ে দেখি বাঙালি এই মেয়ে পাইলটটিকে নিয়ে- আমাদের পৃথুলাকে নিয়ে- বাঙালি পুরুষদের নানারকম বাজে মন্তব্য আর সেইসব মন্তব্যের বিরুদ্ধে আপনাদের সকলের ক্ষোভ, হতাশা, ক্রোধ আর বিরক্তি। আপনাদের ক্রোধ বিরক্তি সবই জায়েজ আছে। কিন্তু যেসব লোকজন পৃথুলাকে নিয়ে এইসব আজেবাজে কথা বলছে ওদের অবস্থানটা একটু ব্যঝতে চেষ্টা করেন। দুইটা গালি দিয়ে থেমে থাকবেন না। ব্যাধিটা কোন জায়গায় সেটা চিহ্নিত করুন। এই লোকগুলি অসুস্থ, কিন্তু এটা নয়া অসুখ না বা একটা সেইসব লোকের ব্যক্তিগত অসুস্থতাও না। এটা অতি পুরনো রোগ- হাজার বছরের পুরনো। ব্যাধিটার নাম পুরুষতন্ত্র। আর এই ব্যাধিতে কেবল ঐসব মন্দ কথাওয়ালারা লোকেরাই যে আক্রান্ত সেটাও ভাববেন না। আপনার আমার চারপাশে যেসকল আপাতনিরীহ ভদ্রলোক ধরনের পুরুষমানুষ দেখি এদের বেশীরভাগও এই ব্যাধিটা আক্রান্ত এবং শেষ বিচারে ঐসব মন্দ কথাবলা লোকগুলি আর আপনার পাশের বাসার ভদ্রলোক এদের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই।

দেখেন, যারা নারীর প্রতি দৃশ্যতই মন্দ মন্দ আচরণ করে- ঐ ইয়ে তো ওড়না কই এই জাতীয় কটূক্তি করে, ওদের কথা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু যেসকল পুরুষ 'অবলা নারী' বলে নারীর কল্যানের কথা বলে কিন্তু নারীকে কখনোই স্বতন্ত্র মানুষ বা স্বতন্ত্র স্বত্বা হিসাবে মানতে চায় না ওদের কথা ধরেন। নারীদের মধ্যেও এরকম একদল আছেন, ওরাই সখ্যাগরিষ্ঠ, যারা নারীর কল্যাণ কামনা করেন, নারী হিতৈষী কিন্তু নারীকে কখনোই স্বতন্ত্র মানুষ ভাবেন না। ব্যাধির মুল সূত্রটা সেখানেই। আপনি যদি মনে করেন যে নারীও মানুষ, শারীরিকভাবে পুরুষের চেয়ে ভিন্ন বটে, কিন্তু প্রতিটি নারীই একেকজন পুর্নাঙ্গ মানুষ, স্বতন্ত্র স্বত্বা, তাইলে আপনার লড়াইটা কেবল সেইসব গালিবাজ মন্দভাষী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধেই সীমিত থাকতে পারে না। আপনাকে মুল জায়গাটাতে আঘাত করতে হবে, বলতে হবে যে না, নারীর কল্যাণ সে তো জরুরী বটে, সেতাত তো চাইই- কিন্তু কল্যাণটাই শেষ কথা নয়- তার আগে চাই নারীর পুর্নাঙ্গ মানুষের মর্যাদা। নারী এবং পুরুষ দুজনেই মানুষ- এর চেয়ে একটুও কম না, একটুও না।

একটু বিস্তারিত ভেবে দেখেন। এই যে লোকগুলি একজন নারীকে পাইলট হিসেবে দেখে অস্বস্তি বোধ করে, পুলিশ হিসাবে নারীকে দেখে অস্বস্তি বোধ করে, কর্মক্ষেত্রে নারীকে দায়িত্বশীল অবস্থানে দেখতে চায় না, পিতার বা মাতার সম্পত্তিতে নারীর সমান উত্তরাধিকার চায় না- এদের মুল বক্তব্যটা কি? এদের মুল বক্তব্য হচ্ছে নারী পুর্নাঙ্গ মানুষ নয়। কন্যা সন্তান পুত্র সন্তানের সমান নয়। একটা ছেলের চেয়ে একটা নারী একটু কম, ঊন- নারী হচ্ছে ঊনমানুষ। নারীকে যারা পুর্নাঙ্গ মানুষ মানেন না এদের মধ্যে যারা 'ভাল', এরা বাড়ীর কল্যাণ চায়- যেরকম নরম মনের মানুষেরা পশুক্লেশ নিবারণ চায়, সেরকম। নারীর অকল্যাণ এরা চায়না বটে- কিন্তু নারীকে পুর্নাঙ্গ মানুষ বিবেচনা করতে নারাজ।

পার্থক্যটা লক্ষ্য করবেন- কল্যাণ ও অধিকারের মধ্যে পার্থক্য। যারা কেবল কল্যাণ চান, এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর যারা বলেন যে না, আগে চাই অধিকার- মানুষের মর্যাদা এরা সংখ্যালঘু। যারা অধিকার চান, এরা কিন্তু যে অকল্যাণ চাইছেন সেটা নয়। অধিকারবাদিদের কাছে কল্যাণও একটা অধিকার- দান নয় খয়রাত নয়।

(৩)
কিন্তু সংখ্যালঘু হলেও অধিকারবাদিদের পক্ষেই আপনাকে থাকতে হবে। নারীকেও অধিকারের দাবীটাই অগ্রসর করে নিতে হবে। আর শেষ পর্যন্ত অধিকারই জয়ী হবে আর নারীও একদিন আমদের পৃথিবীতে মানুষ বিবেচিত হবে।

মনে রাখবেন যারা কল্যাণের কথা বলেন, এইটুকু আসতেও মানুষকে অনেক লড়তে হয়েছে। ঐটুকুও একরকম অর্জন বটে। পুরুষতন্ত্র তো পুরনো ব্যাপার। রাষ্ট্রের উৎপত্তি, পরিবারের উৎপত্তি আর ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎপত্তির সাথে সাথে পুরুষ নারীর উপর মালিকানা জাঁকিয়ে বসেছে। গরু ছাগল জমি জিরাতের মতো নারীও পুরুষের সম্পত্তি বিবেচিত হয়েছে। সেখান থেকে খুব বেশী উত্তরণ যে হয়েছে সেটা বলতে পারছি না, তবে গত দেড় দুই হাজার বছর ধরে খানিকটা গুরুত্ব নারী ফিরে পেয়েছে। এখন ঠিক গরু আর জরুকে আধুনিক মানুষ এক করে দেখে না। নারীকে এখনো পুরুষের অধীন মনে করে বটে, কিন্তু নারীকে মনে করে মূল্যবান সম্পদ। কেউ কেউ বলেন কন্যা সন্তান হচ্ছে মূল্যবান পাথরের মতো মূল্যবান সম্পদ- যেমন হিরের টুকরোটি। লক্ষ্য করবেন, মূল্যবান বটে, তবুও পুরুষেরই সম্পত্তি। এর মধ্যে নারী খানিকটা সম্পত্তির অধিকারও পেয়েছে- পুরুষের সমান নয় বটে, তবে উত্তরাধিকারের অধিকারও পেয়েছে খানিকটা।

এই সবই এক অর্থে অর্জন- কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় নয়। এখন লড়াইটা অগ্রসর হয়েছে ঐখানে- না, নারী পুরুষের অধীন একটুকমমানুষ বা উন-মানুষ নয়, নারী সম্পূর্ণ মানুষ- এই কথাটা প্রতিষ্ঠা করার লড়াইটা এখনকার লড়াই। এইখানে প্রায় পুরো পুরুষ জনগোষ্ঠীই নারীর প্রতিপক্ষ। ওদের মধ্যে ভাগ আছে বটে- সুশীল পুরুষ ওরা আপনাকে বলবে যে না, শোন তোমাদেরকে তো বেশ খানিকটা অধিকার 'দিয়েছি' এর চেয়ে বেশী চেও না। ওড়া কিন্তু সবসময়ই বলবে অধিকার 'দিয়েছি'। কেন? কেননা পুরুষ তো মনে করে সে মালিক- নারীর মালিক, সে তো অধিকার দিবেই। এখন আপনি যদি এই মহান দাতা পুরুষগণকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন বাহে, আমি পুর্নাঙ্গ মানুষ হিসাবে মানুষের মর্যাদা কেন চাইবো না? ওরা তখন ইতং বিতং করে নানান কায়দায় যে জিনিসটা আপনাকে বুঝাবে সেটা হচ্ছে যে- তুমি তো নারী, শুধু মানুষ নও- মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষের বেশী বাড়াবাড়ি করা ঠিক না। তাতে নাকি সমাজের 'ফেব্রিক' নষ্ট হয়ে যাবে। মানে কিনা সমাজের বুনন নষ্ট হয়ে যাবে। বুঝতে পারলেন তো কথাটা? নারীকে এই সমাজ পুরুষের মত শুদ্ধ মানুষ মনে করে না, সুতরাং নারী যদি শুদ্ধ মানুষের মতো নিজেকে দাবী করে তাইলে তো সমাজের বুনন নষ্ট হয়ে যাবে।

এইটাই কথা। সুশীল কল্যানবাদিরা যে কথাটা বলেন, সেটা থেকে কিউ নিতে হবে আপনাকে। এই সমাজের বর্তমান যে বুনন আছে সেটা রেখে নারী কখনোই পুর্নাঙ্গ মানুষ বিবেচিত হবে না। এই বুনন আপনি যতদিন না ভাঙবেন, আপনি যতদিন নয়া বুননে নয়া সমাজ গড়বেন ততদিন নারীকে মানুষ বিবেচনা করা হবে না। পিরিয়ড। দাড়ি। সমাপ্ত।

(৪)
পৃথুলার কথায় আসি। পৃথুলাকে যারা গালি দিচ্ছে, যারা বলছে মেয়েমানুষকে এইরকম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কেন দেওয়া হলো ইত্যাদি, এরা এই কথাগুলি কেন বলে? কারণ পৃথুলাকে ককপিটে চালকের আসনে দেখে ওদের মনে ভয় জাগে। ওদের তীব্র আতঙ্ক জন্ম নেয়। নারী কেন চালকের আসনে থাকবে? তবে কি নারী আমাদের পুরুষের প্রাধান্য মানছে না? নারী তো পুরুষের নীচে থাকবে। পুরুষ থাকবে উপরে। নারীকে চালকের আসনে দেখলে ওদের শঙ্কা জাগে- তবে কি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বুনন ওরা ভেঙে ফেলবে? সেই ভয় সেই শঙ্কা সেই আতঙ্ক থেকে ওদের মনে জন্ম নেয় তীব্র ঘৃণা। ওরা তখন সেইসব নারীকে আঘাত করে যে নারীরা নিজেকে হিরের টুকরো বা জহরত বা মূল্যবান মণিমুক্তা মনে না করে মানুষ মনে করে। ওরা প্রমাণ করে দিতে চায় যে ওরা নারীর মালিক। আর যে নারীটি পুরুষের মালিকানা অস্বীকার করে ওকে তখন পুরুষরা ছাড়াগরুর মতো বিবেচনা করে।

এই যে দেখবেন কথায় কথায় ওরা নারীকে গালি দেয় বেশ্যা বলে- কেন? বেশ্যাই কেন? ভেবেছেন কখনো? বেশ্যার মধ্যে অমর্যাদার কি আছে? ওদের কাছে আছে। ওরা তো প্রোপাগান্ডাটা করে এই বলে যে এজন্য নারীর মালিক থাকবে একজন পুরুষ। পুরুষের মালিকানায় একাধিক নারী থাকতে পারে, কিন্তু নারীর মালিক হবে একজন। আর যে নারীর মালিক নাই সে হচ্ছে তুচ্ছ- বাজে মাল, রাস্তার কুকুর। বেশ্যা তো নিজের মালিক নিজে। সুতরাং বেশ্যা ওদের কাছে অমর্যাদাকর একটা গালি। দামী কুকুরের যেমন এক সময় একজনই মালিক থাকে, আদর্শ নারীরও সেরকম এক সময়ে একজনই মালিক থাকতে হবে। বহুগামিতা নারীর জন্যে নয়। পুরুষের জন্যে সেটা ঠিক আছে। নারীর জন্যে? কভি নেহি।

আর ঐ যে ধর্ষণ বাসে রাস্তায় হয়রানী এইগুলি? এইগুলিও হচ্ছে নারীর প্রতি পুরুষবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। এইগুলি কেউ যৌন তৃপ্তির জন্যে করে না।

আপনারা যারা নারীর অধিকারের জন্যে লড়ছেন, কথাটা আপনারা হয়তো জানেন, মেহেরবানী করে সকল নারীকে জানান- লড়াইটা কল্যাণের জন্যে নয়, অধিকারের জন্যে। আর এই অধিকারটা এই সমাজ রেখে প্রতিষ্ঠিত হবে না। নারীর অধিকারের লড়াই আর সমাজ বদলের লড়াই এইখানে একসুত্রে গাথা। এর কোন শর্টকাট নাই, কোন বিকল্প নাই।

লেখক: আইনজীবী

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত