নারীবাদকে মুক্তি দিন
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০১৮, ১৪:১৫
রাতে যাদুকাটা নদীর পাড়ের শিমুলসারির স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম যে, একলা থাকলে, ভিড়ের মধ্যে থাকলে, বিষাদ আর বেদনায় থাকলে, আনন্দে আর উদ্বেলতায় থাকলে, অভিমান আর ঈর্ষায় থাকলে মানে সবসময়ই যেকোন অবস্থায়ই আমি যার কথা ভাবি, যাকে মনে এবং মাথায় রাখি- তার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছি এই বসন্তে, আগুনরঙা ফুলগুলির মধ্যে। এই ফুল নাকি কোটরা হরিণ ভালোবেসে খায়। রোম্যান্টিক পুরুষ লেখক বুদ্ধদেব গুহর বইতে পড়েছিলাম। শিমুল ফুলের মতো রাঙা আর সজীব আমার হৃদয়টা আমি সেই তারে তুলে দিচ্ছি, নিবেদন করছি- এরকম একটা স্বপ্ন দেখছিলাম।
ভেবেছিলাম অফিস শেষে এই স্বপ্ন নিয়ে বেশ ফেনিয়ে টেনিয়ে একটা গল্প লিখবো। তো ভোরবেলায়ই ফেসবুকে ঢুকে এইসব রোমান্স টোমান্স উড়ে পুড়ে ছাই।
একজন সাংবাদিক (নারী) অদিতি বৈরাগীর ঘটনা কতটা সত্য তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন। সাত তারিখের পর থেকে যেসব ইতরামি দেখছি, এই নারীর ইতরামিও সেই পর্যায়েরই। আমি একে তেমন ভালো চিনি না। তার অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকতা আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসায় তিনি কাজে লাগিয়েছেন এবং তা সমাজের কোন কোন উপকারে এসেছে আমার জানা নেই। কিন্তু অদিতির ঘটনায় তিনি অনুসন্ধিৎসু হচ্ছেন।
আমি ইচ্ছে করলে তাকে আনফ্রেন্ড করতে পারতাম। ইতরামি আর বলদামি কাঁহাতক এবং কতজনেরই বা সহ্য করা যায়। কিন্তু করিনি। করিনি দুই কারণে।
প্রথমত: আমি যে বন্ধু বাতাবরনে চলি তারা সকলেই সমতায় বিশ্বাস করে। নারী হিসেবে আমার যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলো কাটাতে সহায়তা করে। তারা সমাজের এগিয়ে থাকা মানুষ। এদের আবহে থেকে আমি ভাবতে শুরু করি যে সমাজ নারীর জন্য খুব এগিয়ে গেছে। এটা হলো সুবিধাজনক জায়গায় থেকে সব ঠিক আছে ধরনের ভাবনা। এই ভাবনা যে মোটেও সত্য নয় সেটা বারবার টের পাই ফেসবুকীয় বাজারে এলে। কালকে শুধু এই সাংবাদিক নন, আরও দুটো টেলিভিশনে কাজ করা দুইজন সাংবাদিক বা প্রেজেন্টারও দেখলাম একই ভাবনা লিখেছেন। পড়লাম নারীকে তারা কি চোখে দেখেন। আমি বন্ধুসমদের নারী এবং সমাজ বিষয়ক ভাবনা-চিন্তা বোঝার জন্য এদের লিস্টে রাখি।
দ্বিতীয়ত: অরুন্ধতী রায়ের সেই কথাটা। "নিজেকে সতর্ক রাখা, রাখা লড়াই এর যোগ্য"। আমি এদের কথা পড়ে নিজের অ্যাক্টিভিজম আর 'আদর্শ' বলে ইদানিং খেলো যে শব্দটা আছে সেইটা ঠিকঠাক রাখার একটা চেষ্টা করি।
ফলে এদের আনফ্রেন্ড করি না।
কিন্তু আমি এদের নিয়ে কনসার্ন নই। কনসার্ন বরং আমার নারীবাদের লড়াই এর সাথীদের নিয়ে। নারীবাদ এমন একটা লড়াই যার শত্রু সকলে। পুরুষ, ধর্ম এবং ক্ষমতা- এই তিন প্রথম সারির শত্রু। কিন্তু যাদের দেখি নারীবাদের ধ্বজ্বা উড়াচ্ছেন ফেসবুকে বা গণমাধ্যমে তারা কি অবলীলায় অদিতির ঘটনা বানানো এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের বলে প্রচার করছেন! অ্যাজ ইফ এই ঘটনা কোনদিন ঘটে না, এই ঘটনার কোন আশংকা এই সমাজে নেই। এই ঘটনা শুধুমাত্র আমি যেই দল করি সেই দলের লোকেদের দ্বারা ঘটেছে বলে আমি অস্বীকার বা সন্দেহ করছি। অথচ এই ধরনের ঘটনা ঘটে। ঘটে ঘটে ঘটে।
নারীবাদের লড়াইটা কেন সর্বস্তরে এমনকি যে নারীকে সমতার পৃথিবীর কথা বলি সেইসব নারীদের কাছেও পৌঁছায় না তার একটা কারন বোধহয় এই। এই ধরনের নারীবাদ বেচা মানুষেরা। যারা নারীবাদ নামে অ্যাক্টটাকে নিজেরে জাতে তোলার জন্য বেচে প্রতিনিয়ত:, নারীবাদরে খুলে খুবলে খেয়ে নিজের আখের গোছায়।
মানুষ তাদের বিশ্বাস করে না। চিনে যায়। এ কারণে নারীবাদ একটা হাসির আর ইয়ার্কির বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। নারীবাদে তো সকল নারীর প্রতি বৈষম্য আর যৌন হেনস্থার বিপক্ষে কথা বলার কথা। নারীবাদ মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা। সেই অন্যায় যেই করুক- পুরুষ, ধর্ম, ক্ষমতাকাঠামো এবং নারীও যদি করে সেই অন্যায় তবুও নারীবাদীকে কথা বলতে হবে এদের সকলের বিরুদ্ধেই। আপনারা যারা তা পারবেন না দয়া করে নারীবাদ নামক বিষয়টাকে মুক্তি দিন। আপনাদের "করে খাওয়ার" তো অনেককিছু আছে, আপনারা যোগ্য অনেককিছুর। এই বিষয়টাকে মুক্তি দিন এবং তারপর কাছা খুলে অদিতির যৌনহেনস্থা নিয়ে সন্দেহ করুন। কোন অসুবিধা নেই। আমরা আমাদেরকে লড়াই এর যোগ্য রাখবো আপনাদের বিরুদ্ধে।
ফেসবুক থেকে রিহ্যাব করতে চাই এজন্যই। বড় অসুস্থ লাগে। এই বসন্তে আমি ঠিক যাদুকাটা নদীর ধারে যাবো। অদিতির মতো নিজেরও মনের ক্ষত সারাতে।
লেখক: সাংবাদিক