একটি নারী দিবস ও আমাদের নিরন্তর লড়াই
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০১৮, ০১:৪০
সেই কবে থেকে নারী দিবস পালন করে আসছি আমরা! এই এতো বছরে নারী দিবসের জন্য বেগুনী শাড়ির চল যতটুকু দৃশ্যমান হয়েছে, যতোটুকু কর্পোরেট ফ্লেভার যুক্ত হয়েছে, থিম পরিবর্তন হয়েছে, ততটুকু দৃশ্যমান কি হয়েছে নারীর আন্দোলন, লড়াই সংগ্রাম আর ইউনিটি? এই যে এতো বছরের নারী দিবস উদযাপনের ইতিহাস, তাতে কি আমাদের লড়াইয়ের ক্ষেত্র কিছুটা কমেছে? কিছু পুনঃনির্মাণ কি হয়েছে নারীর জন্য?
নারী দিবসের আয়োজনকে সামনে রেখে এই প্রশ্নগুলো আমাদের আলোচনা করতে হচ্ছে কারন এখনো অন্যপক্ষ থেকে সেই পুরনো প্রশ্নগুলো বারবার সামনে আসছে, "আমাদের লড়াই আসলে কার সাথে? আমরা আসলে কী চাই? আমরা কি পুরুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি? আমরা এতো পুরুষ বিদ্বেষি কেন?" ইত্যাদি ইত্যাদি।
এর আগে বহুবার আমার পূর্বনারীরা এসব কথার উত্তর দিয়েছেন। তবু, আমি আবার বলি। আমাদের লড়াই কার সাথে সে প্রশ্ন না করে বলুন আমাদের লড়াই কার সাথে নয়? আমাদের এতো রাগ কেন, সেই প্রশ্ন না করে বরং বোঝার চেষ্টা করুন রাগ না হওয়ার মতো ঠিক কী ঘটেছে আমাদের সাথে? বাসের ক’টা রিজার্ভ সিট, সংসদে কিছু সংরক্ষিত আসন, কিছু উচ্চপদে পুরুষতন্ত্রের আজ্ঞাবহ নারী, পুরুষতান্ত্রিক বিধি বিধানের কিছু আইন, চাকরিতে কিছু বিশেষ কোটা, বউ এর হাতে একটা সাপ্লিমেন্টারি কার্ড বা অতিদূর একটা ফ্ল্যাটের দলিল দিয়েই ভাবছেন সব ঠিক হয়ে গেছে? ঠিক যেমন ‘আর কত চাই তোমার’!! না এতো সরল নয় এই রাজনীতি।
নারীবাদী কবি ‘অ্যাড্রিয়েন রিচ’ এর মতো করেই বলি, “অধিকারবোধ বা চেতনার জাগরণ সীমান্ত পেরোনোর মতো নয় যে, এক পা এগুলেই তুমি অন্যদেশে। নারী যতদিন নিজের কথা নিজে না লিখবে, যতদিন নিজের প্রথা নিজেই না তৈরী করবে, যতদিন আমরা দূরত্বে থেকে দেখার চেষ্টা করবো, ততদিন মেয়েদের বাস্তব অবস্থার সাথেই বিশ্বাসঘতকতা করা হবে”।
আজকের নারী দিবিসের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমরা দেখি, বাংলাদেশে নারীর সমান অধিকারের আন্দোলনে এখনো নারীদের বড় একটা অংশের কোন সম্পৃক্ততা তো নেই-ই, ন্যুনতম কৌতুহল পর্যন্ত নেই। কারন, পুরুষতন্ত্র নারীর মনোজগতও নির্মাণ করেছে নিজেদের মতো করে। নারীর সমান অধিকার আন্দোলন নিয়ে বিরক্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এমন শিক্ষা-দীক্ষা, প্রথা-প্রচারণা চালিয়ে এসেছে যেন নারী নিজের অস্তিত্ব, স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ইত্যাদি মৌলিক মানবিক বিষয়ে ভাবার সুযোগ না পায়। পুরুষরা নিজেদের সুবিধামতো জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের চর্চায় অগ্রসর হয়ে যেখানে পৌঁছে গেছে, সেখানে নারীদের জন্য আলাদা করে একটা মতবাদ বোঝার জন্য বা চর্চা করার জন্য কোন ক্ষেত্র অনায়াস করে রাখেনি। এই পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজে তাই নারীবাদ চর্চাকে আরও বহুকাল বহু অন্ধকার মোকাবেলা করেই এগুতে হবে।
যে কোন অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ নিশ্চিত করতে হয়। তাই নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামেরও নিশ্চিত প্রতিপক্ষ হলো সেইসব পুরুষ বা নারী, প্রথা-নিয়ম-কানুন, আইন, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞাপন, চলচিত্র, যা পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতা আর আধিপত্যের জমিনকে পোক্ত করে। এটা দুটো আদর্শের মধ্যকার লড়াই। এর একদিকে রয়েছে যারা নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য ও উঁচু-নিচু ধারনাকে বাতিল করে সমতা, ন্যায়বিচার এবং সাম্যব্যবস্থার সমাজ গড়তে চায়; আর অন্যদিকে রয়েছে যারা বিদ্যমান অবস্থা বজায় রাখার জন্য নারী নিপীড়নকে যে কোন ধরনের যুক্তি দিয়ে জাস্টিফাই করে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভিক্টিমকে ব্লেইম করে থাকে।
তাই আমরা যখনই নারী নির্যাতন, সহিংসতা, নিপীড়ন এবং বৈষম্য নিয়ে লিখি, তার প্রথম আঘাতটা পুরুষের ঘাড়েই পড়ে। কারন নারীকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য পুরুষতান্ত্রিক এসব নিয়মের জন্ম দিয়েছে পুরুষ এবং সেসবের সুবিধা নিয়ে এসব নির্যাতন আর বৈষম্য পুরুষের হাত দিয়েই ঘটে। যেমন, নারীকে ধর্ষণ করে একজন পুরুষ, নারীকে এসিডে ঝলসে দেয় একজন পুরুষ, নারীকে কোপায় একজন পুরুষ, নারীর চরিত্রহনন করে একজন পুরুষ। শিশুকন্যা বিয়ে করে একজন পুরুষ, যে পিতা কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিতো, সেও একজন পুরুষ। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেটি পুরুষ তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে না।
সেই সব নারীদের সাথেও আমাদের লড়তে হয় যারা পুরুষতন্ত্রের পার্পাস সার্ভ করতে গিয়ে নারীবাদ আন্দোলনকে বিতর্কিত করে, নারীবাদ আর মানবতাবাদের বিতর্ক জুড়ে দিয়ে বিভাজন তৈরি করে, শুদ্ধ-অশুদ্ধ, তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক নারীবাদের ধোয়া তুলে নারীদের বিভক্ত করে। আমাদের শক্তিক্ষয় করতে হয় সেই নারীদের পেছনে, যারা পুরুষতন্ত্রের ভাষায় কথা বলেন, পুরুষের পক্ষ হয়ে অধিকারকামী নারীদের আক্রমণ করেন, পুরুষতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে সমাজের মনমতো ‘আদর্শ’ তৈরি করেন, নিজেদের মতো করে সেই আদর্শের ব্রান্ডিং করেন এবং পুরুষের তৈরি বৈষম্যমূলক নিয়মের ভিত্তি পাকা করেছেন।
আমাদের লড়তে হয় সেই ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে যা পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব বহন করে এবং নারীকে হেয় করে। আমরা সেই ভাষা পুনঃনির্মাণের কথা বলি, যে ভাষার রাজনীতি ‘বেশ্যা-পতিতা-খানকি-ছিনাল-বনিতা-ভ্রষ্টা-কুলটা-বন্ধ্যা–মাগী-ব্যাভিচারীনি, দ্বিচারিনি’ এরকম হাজার একপেশে শব্দ তৈরি করে নারীকে কলঙ্কিত করেছে। আমরা চ্যালেঞ্জ করি সেইসব পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্য ও কবিতা যেখানে প্রেমের নামে নারীর উপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণকে মহিমান্বিত করা হয়েছে, পুরুষাধিপত্যের জয়গান গাওয়া হয়েছে, এমনকি নারীর মনস্তত্বে পুরুষ শ্রেষ্ঠত্বের বীজ বপন করা হয়েছে।
নারীর জন্য একটি মানুষের পৃথিবী নির্মাণ করার জন্য আমাদের লড়তে হয় পুরুষতন্ত্রের সৌন্দর্যের রাজনীতি ও পুঁজিবাদী সৌন্দর্য ব্যবসার সাথে। যে রাজনীতি মেয়েদের এন্টিএইজিং, ওয়েক্সিং, ফেসিয়াল, জিরো ফিগার, ট্রেডমিল, সিলিকন ব্রেস্ট এ ব্যস্ত রেখে ভুলিয়ে রাখে নিজের অধিকার বোধ থেকে, যেন তারা নিজেদের রোজগার, মেধা, সময়, সবকিছু ওই সৌন্দর্য চর্চার পেছনে খরচ করে স্বনির্ভরতার চিন্তা থেকে দূরে থাকে। চুলের যত্ন করে, বিনুনি গেঁথে, বাহারী খোপা বেঁধে, সময় কাটিয়ে নারী দূরে থাক উৎপাদনশীলতা থেকে, নিজের রোজগারের টাকা উড়িয়ে দিক সেক্সি হেয়ার স্টাইলের পেছনে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় চলে যাক বিউটি সেলুনে আর পুরুষ এই ফাঁকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকুক এবং আরো যোগ্য করে তুলুক, নিজের মোটা পকেট আরো মোটা করতে থাকুক, আরো বেশি রোজগারে মন দিক, স্বপ্নকে আরো উঁচুতে নিয়ে যাক।
আমাদের লড়াই করতে হয় পুরুষতান্ত্রিক গণমাধ্যম ও বিজ্ঞাপনের সাথে যেখানে নারী মানেই বাথরুম ক্লিনার, কাপড় ধোয়া, পরিষ্কার না হলে স্বামীর ঝাড়ি খাওয়া, ডিশ ওয়াস, রান্না করা, পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পুরুষকে খাওয়ানো। নারীকে দেখানো হয় স্বামীর সকাল বেলার খবর পড়ার আয়েশ নষ্ট করে খুন্তি হাতে বাজারে যাওয়ার তাগাদা দিতে থাকা দজ্জাল বৌ হিসেবে! বেবি ফুড বা টয়লেট্রিস এর বিজ্ঞাপনে বার্তা দেয়া হয় যে শিশুর স্বাস্থ্য ও আরামের জন্য মাকেই সব কিছু করতে হয়, অথচ বাবার কোন দায়ই নেই বাচ্চাকে বোঝার!!
পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার প্রথম শোষকশ্রেনী ‘পুরুষ’ আর প্রথম শোষিতশ্রেনী ‘নারী’, সুতরাং লড়াইটা এই দুই শ্রেনীর মধ্যেই। পরিবারে, সমাজে, প্রতিষ্ঠানে, রাজনৈতিক দলে পিতৃতন্ত্রেরই জয়গান, সেখানে নারীর মর্যাদা প্রশ্নটি অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। ধর্মের বইতে এই বৈষম্যের শুরু আর আইনে তার প্রতিধ্বনি। আমরা আইনের বৈষম্যগুলো দূর করতে চাই যেখানে ‘মা’ কে তার গর্ভজাত সন্তানের অভিবাবকত্বের অধিকারটুকু দেয় না, সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকার করে না, যে আইনের প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাকে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বারবার ধর্ষিত হতে হয়। আমাদের নিজস্ব আন্দোলন, নিজস্ব রাজনীতি দিয়ে আমরা লড়াই করি মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সব আইন পরিবর্তন, সংশোধন ও নারীবান্ধব আইন তৈরি করার জন্য।
তাই আমরা আঘাত করি, আমাদের বারবার আঘাত করতে হয় পুরুষতন্ত্রের অচলায়তনে। পুরুষতন্ত্রের নীল নকশায় তৈরি লৈঙ্গিক রাজনীতিকে আমরা প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করি, সেটা পরিবার, কর্মক্ষেত্র, গণমাধ্যম, রাষ্ট্র সবখানেই। পরিবারে, সমাজে, প্রতিষ্ঠানে, রাজনৈতিক দলে পিতৃতন্ত্রেরই জয়গান, সেখানে নারীর মর্যাদা প্রশ্নটি অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। এখানে গোপনীয়তার কিছু নেই। পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি যেভাবে নারীকে নিপীড়ন করেছে এতোকাল, তাকে অতিক্রম করে গড়ে উঠছে আজকে আমাদের নিজস্ব আন্দোলন, আমাদের নিজস্ব রাজনীতি।
অবধারিতভাবেই এই রাজনীতির পথ কণ্টকময়, কলঙ্কিত, এবং বন্ধুর। আমরা জানি, নতুন প্রাণের আবির্ভাবের জন্য পুরোনো বীজকে ভাঙ্গতে হয়। বেদনা ছাড়া সন্তান প্রসব হয় না জেনেই আমরা পরিবর্তনের এই যন্ত্রণাকে স্বীকার করে নিয়েছি। একদিন নারীদিবস আসবে প্রাপ্তির ফসল কাটার কাস্তে নিয়ে, সেই দিন নারীর জন্য আলাদা কোন দিনের প্রয়োজন হবে না। পরিবর্তনের এই বেদনাকে আমরা তাই বারবারই আলিঙ্গন করতে চাই।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ