সমস্যাটা ‘নারীবাদী’ পুরুষে?
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০১৮, ০০:০৯
একজন নারীবাদী পুরুষ ‘ধরা’ খাইসেন। আজকে সকাল বেলা সমগ্র বাংলাদেশ একটন হয়ে আতকা জানতে পারলাম ইমতিয়াজ মাহমুদ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরও একমাত্র ব্যক্তি যিনি কিনা একখানা আস্ত বউ ও জলজ্যান্ত দুই কন্যা রাইখা একটা অসম (?) প্রেমে জড়াইসেন। জড়াইসেন তার কন্যার বয়সী (?) একজনের সাথে। এবং এই সম্পর্কে তিনি একা একাই জড়াইসেন। এই সম্পর্কের ওই পারে কেউ ছিলো না। এর আগে কেউ কোনদিন এইরকম গর্হিত অপরাধ করে নাই। তিনি একজন নারীবাদী পুরুষ বলেই সুন্দর সুন্দর কথা বইলা অবুঝ অবলা সহজ সরল কচি মাইয়াটারে প্রেমের নামে প্রতারণা করসেন, বিছানায় নিয়ে যাওয়ার ধান্ধা করসেন!!
এখন আপনারা এই দুনিয়ায় সবাই সাধু সন্তের দল এখন ইমতিয়াজ মাহমুদের সাথে সাথে তার নারীবাদ, নারীরে সম্মান করা, নারীর জন্য লড়াই করা সব একসাথে মাটির সাথে মিশাই দিতেসেন। কারন, নারীবাদী পুরুষ হইয়া তিনি প্রেম করসেন। বিরাট অপরাধ করসেন। একেতো নারীবাদী তার উপর পুরুষ, তার উপর গোপন প্রেম!! এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। গোপন প্রেম, প্রকাশ্য প্রেম, সম প্রেম, অসম প্রেম এসবই আসল 'পুরুষ'দের একছত্র মালিকানায়। তাদের জন্য সব জায়েজ। কিন্তু নারীবাদী পুরুষরা ঠিক পুরুষ না। তারা হলেন ঊন-পুরুষ। আসল পুরুষের দল এবার মওকা মতো একজন নারীবাদী পুরুষরে পাইসেন। এই সুযোগ ছাড়া যাবে না।
এই দেশে নারীবাদী পুরুষের অপরাধ অনেক বড়। নারীবাদ বিষয়টারে গান্ধা করার জন্য আসল পুরুষদের এই যে এতো এতো পরিশ্রম সব ভণ্ডুল হয়ে যায় এই গুটি কয়েক নারীবাদী পুরুষদের জন্য। সুতরাং এখন যুথমতো পেয়ে তারে ধোলাই করতে হবে। গণ-ধোলাই চলতেসে। আসল পুরুষ আর আসল নারী একযোগ হয়ে আক্রমন করছেন। সারাদিন আক্ষরিক অর্থে ইমতিয়াজ মাহমুদরে ভার্চুয়ালি ধর্ষণ করে ছেড়েছেন। বাহ!
ওয়েট, ওয়েট ! ইমতিয়াজ মাহমুদের পক্ষ নিসি বইলা যারা আমারে ধুইতে আসতেসেন, তারা দয়া করে একটু অপেক্ষা করেন ভাই ও বোনেরা। যে কোন মানবিক ও ব্যক্তিগত দোষ ত্রুটির জন্য নারীবাদরে ধুয়ে নেওয়ার মওকা লুফে নেয়া একটা মানসিক ব্যধি। আবার কারো ভালো ভালো পোস্ট পইড়া তারে ফেরেশতা ভাইবা নেওয়াটাও এক প্রকার ব্যধি। ইমতিয়াজ মাহমুদ একজন মানুষ, রক্ত মাংসের মানুষ এবং সমস্ত মানবিক ও জৈবিক চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। তিনি একজনের সাথে অবৈবাহিক সম্পর্কে জড়াইসেন এবং তা অন্যপক্ষের সম্মতি ও আগ্রহ নিয়েই জড়াইসেন।
এখন সেই সম্পর্করে আপনি আমি নৈতিক অনৈতিক প্রতারনা বিশ্বস্ততা ইত্যাদি ছাঁচে ফেলে কাউরে জাস্টিফাই করার কিছু নেই। ইনফ্যাক্ট যখন প্রাপ্তবয়ষ্ক দুজন মানুষ প্রেম করে বা বন্ধুত্ব করে, সেটা করার সময় কারো জাস্টিফিকেশন নিয়ে করে না। আর বুড়া মানুষ কন্যার বয়সীর সাথে প্রেম করসে ক্যান কিংবা বুড়ি মানুষ পোলার বয়সীর সাথে প্রেম করসে ক্যান এসব আবালীয় প্রশ্নেরও উত্তর দেয়ার কিছু নাই। এসব জন্ম জন্মান্তরের সংস্কার। এক ঘষাতেই যাবে না।
কিন্তু যে মানুষ দুইজন এসব সংস্কারকে পাশ কাটায়ে এরকম সম্পর্কে জড়াইসেন, তারা দুইজনেই নিজ দায়িত্বেই জড়াইসেন। এখন যে প্রতারণার কথা প্রীতি বলসেন, সেটা আসলে কি? একজন মানুষের প্রতিদিন সুখী সংসারের পোস্ট দেইখ্যাও প্রীতি সরল মনে (?) বিশ্বাস করে উনার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সম্পর্কে জড়াইলেন, আগামীর স্বপ্ন দেখলেন। এবং বলা বাহুল্য, এই স্বপ্ন অতি অবশ্যই প্রীতি নিজ দায়িত্বে দেখসেন। কারন, ইমতিয়াজ মাহমুদ তার স্ত্রী কন্যার কথা গোপন করে প্রীতির কাছে বিয়া করবেন অঙ্গীকার করসেন এমন কোন খবর আমরা এই পর্যন্ত জানতে পারি নাই।
যাই হোক, যে কোন সম্পর্কই স্বপ্নদোষে দুষ্ট। প্রীতিও স্বপ্ন দেখসেন। তবু সব স্বপ্নই এক সময় ভাঙে। এখন স্বপ্ন ভাঙসে বইলাই ইনবক্স এর অন্তরঙ্গ কথা বার্তার স্ক্রিনশট ফাঁস করে সেটা নিয়ে ৭২০০০০ ফলোয়ারের দরজায় দাঁড়ানোটা কোন সততার পর্যায়ে পড়ে? ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা রগরগাইয়া বইতে বা ফেইসবুকে লিখে ফেলারেই নারীবাদ কয় না। আর নিজেরে ভিক্টিম সাজাইয়া পাবলিক এটেনশন নেয়াটাও কোনভাবে নারীবাদ হইতে পারে না। প্রীতি যেইটা করসে সেটা অন্যায় এবং প্রচলিত আইনে অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দিন শেষে এইটারে ব্ল্যাকমেইলিং বলে।
আর যারা ইমতিয়াজ মাহমুদের সুখী দাম্পত্যের ছবি দেইখ্যা তার স্ত্রী প্রতারিত হইসেন বইলা চিক্কুর পাইরা কানতেসেন, দেখি তিনি এখন কি করেন বইলা তাকে একেবারে ন্যায়বিচারের কঠিন দন্ড হাতে ধরাই দিয়া পুলসিরাতের পুলে তুইলা দিসেন তাদের বলি, আপনারা ক্যান ধরে নিসেন যে তার স্ত্রী এই সম্পর্কের কথা জানতেন না? ক্যান ধরে নিসেন যে, সুখী দাম্পত্যের একমাত্র চাবিকাঠি হইলো সঙ্গীর আবেগ অনুভূতির উপর তালা চাবি দিয়া রাখা আর চোর পুলিশ খেলা? কে আপনাদের কইসে যে, সুখী দাম্পত্য মানে নিজেরে চর্ম চোষ্য লেহ্যহীন সাধু সন্ত প্রমাণ করার জন্য চরিত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া?
উন্নত দেশে ওপেন রিলেশনশিপ নামে একটা টার্ম জনপ্রিয়, যেটা এই দেশে পরকীয়ার চাইতে বিভীষিকাময়। ভুলেও কেউ এই গান্ধা ছাতা পড়া সমাজে এই শব্দটা উচ্চারন করে না। চর্চা তো বহুত দূর কা বাত। কিন্তু ইমতিয়াজ মাহমুদের স্ত্রী উন্নত ও সভ্য দেশে বড় হইসেন, পড়ালেখা করসেন। ইমতিয়াজ মাহমুদের শিক্ষিত স্ত্রী নিশ্চয়ই ওপেন রিলেশনশিপ এর মতো স্বাস্থ্যকর এই বিষয়টা জানেন এবং মানেন। তিনি নিশ্চয়ই জানেন যে, ‘বন্ধন’ মুক্ত থেকেও যে ‘বন্ধন’ টিকে থাকে, সে সম্পর্কের নামই মুক্ত সম্পর্ক। পারষ্পরিক শ্রদ্ধা, সাতন্ত্র্য এবং বন্ধুত্ব এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি। এই সম্পর্ক টেকানোর জন্য ইলাস্টিক লাগে না, অনুভবে এই সম্পর্ক টিকে থাকে আপন মহিমায়।
বেশিরভাগ সময়ই দুজন মানুষ এক সাথে, একই বন্ধনে থাইকাও নিজেদের মধ্যে একে অপরের সম্পৃক্ততা বা অপরিহার্যতা না বোধ করতে পারে। সেই সময়টাতে একে অন্যরে না ঠকিয়ে, অভিনয় না করে, স্বেচ্ছায় সমঝোতার মাধ্যমে সম্পর্ক থেকে নিজেদের সাময়িকভাবে মুক্ত করে নিতে পারলে অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। এই সাময়িক মুক্তি নিজেদের প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পেতে অন্তর্জগতের দরজা খুলে দেয়, যার ফলে দুজন মানুষ নিজেদের কাছে এমন সম্পর্ক নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যে সম্পর্ক দুজনের কারো কাছেই 'গ্রান্টেড' হয় না, বরং 'নীড' হয়ে ওঠে। এই সম্পর্করে ওপেন রিলেশনশিপ বা মুক্ত সম্পর্ক বলে। কেউ কারো ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি ঝুঁকি না মেরেও যে চমৎকার ভাবে ঘর, বিছানা এবং জীবন শেয়ার করা যায় সে শিক্ষাটুকু ইমতিয়াজ মাহমুদ এবং তার স্ত্রী উভয়ের আছে বলেই আমি মনে করি। সুতরাং তিনি এখন ইমতিয়াজ মাহমুদরে তার ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রেমের দায়ে ফাঁসি দিয়া দিবেন সেটা আমার মনে হয় না।
ভাই ও বইনেরা, আল্লাহ পাক মগজ কবরে নিয়া পোকার খাবার বানানোর জন্য দেন নাই। পড়াশোনা কইরা এই দুনিয়ায় খাটানোর জন্য দিসেন। সুতরাং যেইখানে সেইখানে নিজের নাকটারে গলানো বন্ধ করে মগজটারে একটু খাটান। একটু পড়াশোনা করলেই বুঝতে পারবেন, মানুষের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়ন ও দোটানার ভেতর সম্পর্ক একটি বড় টানাপোড়ন। প্রেমও তাই। কারো সাথে থাকা মানেই তারে পাওয়া হয়ে গেসে, বা একবার পাইসেন বইলা তারে আজীবন পাইতে থাকবেন সেই সূত্র প্রেমে খাটে না। প্রেমে যতোটা পায় একজন মানুষ তার চাইতে অনেক বেশী পায় না। কোন মানুষই কোন ছাঁচে ফেলে এই টানপোড়নরে অতিক্রম করতে পারে না। এটা মানুষের অস্বিত্বের টানাপোড়নের সাথে সম্পর্কিত।
সুতরাং মানব সম্পর্ক নিয়া জাজমেন্টাল হওয়া বন্ধ করেন। একজন মানুষ সে নারীই হোক আর পুরুষই হোক নারীবাদ করে বইলা অথবা করে না বইলা তারে আপনার বানানো উচিত অনুচিতের ফ্রেম মতো শুদ্ধি পরীক্ষা দিয়া সম্পর্কে জড়াইতে হইবো এইসব ফাঁপা কথা বার্তা এবার একটু থামান। ফুলস্টপ।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ