নাবিলা জানো: রোমান্টিকতার মোড়কে হয়রানি
প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০১৭, ০২:০৯
নব্বই দশকে একটা খুব জনপ্রিয় হিন্দি গান ছিল। গানটা হলো, "ও লাল দোপাট্টে ওয়ালী তেরা নাম তো বাতা"। গানটাতে দেখা যায়, দুটো অতি ছ্যাঁচড়া টাইপের ছেলে দুটো মেয়েকে বিরক্ত করছে, গানের সুরে সুরে তাদের নাম ধাম সবই জানতে চাইছে। শুধু তাই নয়, রাস্তার ওপর মেয়েগুলোর ওড়না ধরে এবং কালো জ্যাকেট ধরে টানাটানিও করছে। গানের শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, মেয়েগুলো ছেলে দুটোর এই ছ্যাঁচড়ামিতে গলে যায় এবং পরবর্তীতে চারজন একসাথে কোমর ধরাধরি করে নাচতে থাকে। শুধু এই একটি গান নয়, বাংলা এবং হিন্দি সিনেমার অনেক গানেই আমরা দেখেছি অনিচ্ছুক নায়িকা বার বার প্রত্যাখ্যানের পরও নায়কের ছ্যাঁচড়ামি এবং বখাটেপনা অব্যাহত থাকায় নায়িকা শেষ পর্যন্ত (আমার কাছে সবসময় মনে হতো ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়েই) নায়কের প্রেম প্রস্তাবে সম্মতি দিতো।
হিন্দি ও বাংলা সিনেমায় ক্রমাগত এসব দৃশ্য দেখানোর ফলটা হয়েছিল মারাত্মক। ছোটোবেলা থেকেই দেখতাম, আমার সুন্দরী বান্ধবীদের ছেলেরা কী পরিমাণ বিরক্ত করতো। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই, হাতে চিঠি গুঁজে দিয়ে চলে যাচ্ছে, অথবা দিচ্ছে ফুল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শিস দিয়ে যাচ্ছে বা নাম ধরে চিৎকার করে আই লাভ ইউ বলে যাচ্ছে। প্রেম প্রস্তাবে রাজি হওয়ার জন্য আত্মহত্যার হুমকি, ব্লেড দিয়ে হাত কাটা, বার বার নিষেধ করার পরও বন্ধুবান্ধবদের দিয়ে বাসায় ফোনের পর ফোন করানো, এমন কিছু নাই যে ছ্যাঁচড়াগুলো করে নাই। একজনকে নাকি রাস্তায় লাঠি দিয়ে বাড়ি মারারও হুমকি দিয়েছিল তার প্রেমিকের বন্ধু, যদি সে প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ব্যাপারগুলো যে হ্যারাসমেন্ট সেটা বোঝার মতো মানসিকতাও তখনকার দিনে বেশিরভাগ মানুষের ছিল না। কারণ তখন ধারণা করা হতো এসব আচার আচরণ নায়কোচিত। আর মেয়েরা মুখে তো না বলবেই। তাদের ছলে বলে কৌশলে হ্যাঁ করানোই নায়কের কর্তব্য। বহু সুন্দরীকে তখন লুকিয়ে কাঁদতে দেখতাম। কারণ একে তো তারা বহু সংখ্যক প্রস্তাব পেতো, সবার প্রস্তাবে তো আর হ্যাঁ বলা সম্ভব না, যাদেরকে না বলেছে তাদের ছ্যাঁচড়ামিতে এই মেয়েগুলোর জীবন হতো অতিষ্ঠ। অপরদিকে যেহেতু ছেলেরা ধোয়া তুলসীপাতা, সোনার চামচ এবং হীরার আংটি, কাজেই তারা মেয়েটার জীবন অতিষ্ঠ করলেও দোষ হতো মেয়েটারই। ছেলের মা বাপ হয়তো বলতো, আমার ছেলেটা ভালো, ডাইনি মেয়েটাই মাথা ঘুরিয়েছে ছলাকলা করে। অপরদিকে মেয়ের মা বাপ বলতো, এত মেয়ে থাকতে তোর সাথেই বা এমন হয় কেন, নিশ্চয় তুই ইশারা ইঙ্গিত করেছিস। এক্ষেত্রে কোনো দোষ না করেও অপরাধী হয়ে থাকতে হতো মেয়েটিকেই।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলা এবং হিন্দি সিনেমার জগতে চমৎকার কাহিনি নির্ভর চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে। নায়িকার অবজেক্টিফিকেশন তেমন বন্ধ না হলেও নায়কের ইভটিজিং এর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে নায়িকা গিয়ে দড়ি-কলসীর মতো নায়কের গলায় ঝুলে পড়ছে এরকম ছবি কম দেখা যায়। এমনকি কনসেন্ট বিষয়টা কতোটা জরুরি সেটা নিয়ে তৈরি হয়ে গেছে পিংক এর মতো অতি অসাধারণ একটা ছবি। কিন্তু উপমহাদেশের বেশিরভাগ মানুষের মানসিকতা এখনও নব্বই দশকের সিনেমার "ইভটিজিং এর মাধ্যমে প্রেম" বা "ছ্যাঁচড়ামির মাধ্যমে প্রেম থেকে" মুক্ত হতে পেরেছে কি?
দুঃখের বিষয়, "নাবিলা জানো" নামক আপাত রোমান্টিক কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিরক্তিকর ক্যাম্পেইনটার এত রেসপন্স দেখে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। নাবিলা নামের মেয়েটি এই ক্যাম্পেইনের পরিচালককে কেন প্রত্যাখ্যান করেছিল আমরা কেউ জানি না। কারণ তো অনেক কিছুই হতে পারে। হয়তো নাবিলা বিয়ের পর চাকরি করতে চায়, ছেলেটি রাজি নয়। হয়তো নাবিলা বিয়ের পর নিজের মতো থাকতে চায়, ছেলেটির দাবি নাবিলাকে তার পরিবারের সাথে থাকতে হবে। হয়তো ছেলেটির রুচি, মনমানসিকতা কোনো কিছুই নাবিলার সাথে মিলে না। হয়তো নাবিলা ছেলেটিকে বন্ধু ভেবেছিল, অন্য কোনো অনুভূতি তার মধ্যে আসেনি। এর জন্যে তার নাম লিখে পুরো দুনিয়ায় সাইনবোর্ড প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? সেটা আবার ফেসবুকে পেইজ তৈরি করে পাবলিক পোস্ট দিয়ে দুনিয়াসুদ্ধ সবাইকে জানাতেও হবে?
নাবিলার পরিচয় প্রকাশ না করে এই ছেলেটি নিজেকে বিরাট সাধু হিসেবে প্রমাণ করতে করতে চাইলেও আমরা সবাই এটা ভুলে যাচ্ছি যে নাবিলা মেয়েটি এবং তার আত্মীয় স্বজন বা কাছের মানুষরা হয়তো ছেলেটির সম্পর্কে জানে। হয়তো ছেলেটির এসব ছ্যাঁচড়ামি এবং নাছোড়বান্দা কার্যকলাপের কারণে মেয়েটি পদে পদে তার আত্মীয় স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের কাছে বিব্রত হচ্ছে, হয়তো মেয়েটিকে তার আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবরা এই ছেলেটিকে গ্রহণ করার জন্য অনবরত মানসিক চাপ দিয়ে যাচ্ছে, যে কোনো কিছুই তো হতে পারে, তাই না?
আচ্ছা, যারা এই বিষয়টিকে সমর্থন করছেন, কাল যদি আপনাদের কন্যা, বোন, স্ত্রী কোনো ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করার পর ছেলেটি তাদের নাম সাইনবোর্ডে বা প্ল্যাকার্ডে লিখে এভাবে অনবরত জনসমক্ষে প্রেম প্রস্তাব দিতে থাকে, তবে মেনে নিতে পারবেন তো?
বৈশালী রহমান এর ফেসবুক থেকে