ভাষার পুরুষতান্ত্রিক বাঁধ
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:৫১
ফেসবুকে এবং ফেসবুকের বাইরেও 'নারীবাদ' শব্দটা গালিতে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। প্রতি দুই পোস্ট পরপর নারীবাদ বিষয়ক একটা ট্রল বা খিস্তি খেউড় চোখে পড়বেই। নারীকে সর্বোতভাবে মানুষ ভাবতে না পারা পুরুষকূল এবং নারীরাও এইসবে মজা পায়। কিছুদিন আগে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বিষয়ক একটা লেখা নিয়ে তোলপাড় হওয়ায় এবং আমরা লেখাটা নিয়ে দুচার কথা বলায় আমার ইনবক্স 'বেশ্যা' গালিতে ভরে যাওয়ায় এবং এর কিছুদিন পর পূজা উৎসব ভালোবাসি এইকথা বলায় আমি যে কত বড় 'বেশ্যা' সেই সংক্রান্ত অগুনতি ম্যাসেজ পেয়ে থম মেরে দুদিন শুধু ফেসবুক স্ক্রল করেছি। করে করে যা বুঝেছি তা হলো, নারীর মুক্তি অনেকে একটু-আধটু চাইলেও নারীর বলার ভাষায় প্রচন্ড আপত্তি সকলের। নারী কেন ব্রা-পেন্টি, স্তন, পিরিয়ড এই শব্দগুলো বলবে এ নিয়ে তাদের আপত্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণা। বলতে দ্বিধা নেই, এইসব নিয়ে লিখে লিখে ত্যানা প্যাঁচানিদের আমারও অপছন্দ। অনেকেই 'পিরিয়ড চলছে, খুব যন্ত্রণা হচ্ছে' টাইপ পোস্ট ইনিয়েবিনিয়ে অথবা একলাইনে হলেও প্রতিমাসেই একবার করে দেওয়াকেই নারীবাদ বলে মনে করেন। এতেই বিরাট স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে বলে মনে করেন। এইটা ভেবে আমি যারপরনাই বিরক্ত হতাম।
কিন্তু খুব গভীরভাবে ভেবে দেখি, কথা তো মিথ্যা না। এই সময় একজন নারী যে মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যায় তা তো এতদিন সমাজ এবং সমাজের পুরুষেরা ভেবে দেখেনি। নারীর নিজস্ব ভাষা তৈরি হয়নি কোনদিন। কি সাহিত্যে কি দৈনন্দিন কাজের ভাষায়। নারীর কোন লেখ্য ভাষা নেই। নারীরা বলতে পারে এমন কোন ভাষা নেই। ভাষা এবং শব্দ সবসময় তার বিরুদ্ধে যায়। নারী যা লেখে তাও তেমন শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে না সামাজিক নানা কারণে। তার মানে নারী কি লিখতে জানে না? আমি নারীকে বুঝতে পারা পুরুষ লেখকদের লেখায় চিরকাল গদগদ হয়েছি। এবং দিনান্তে দেখেছি, তারাও পুরুষের মতো করেই কথা বলেন।
পুরুষ লেখকেরা উপন্যাসে সংলাপ দেন,
: আমি ছুটিকে শাড়ি উপহার দিয়ে বললাম, ছুটি, শাড়িটি একদিন পরে দেখিও, আরেকদিন না পরে!
এইসব রোম্যান্টিক গা শিউড়ানো, মন কেমন কেমন করা উপন্যাসগুলোতে নারীর পিরিয়ডকালীন সময়ের মেজাজ খারাপ, শরীর খারাপ ইত্যাদির কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।
শুধু গল্প উপন্যাসে কেন, নাটক-সিনেমা বা কবিতাতেও এসব নিয়ে কেউ তেমন কিছু লেখেননি।
তো এখনকার ফেসবুকীয় পুরুষেরা ভাবতেই পারেন,
"এই জিনিস কি আমাদের মা-বোনদের হয় না? কই তাদের তো এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে দেখি না।"
বস্তুত আমাদের ভদ্রপুরুষগণ নারীকে মা-বোনের বাইরে আলাদা ব্যক্তিসত্ত্বা হিসেবে দেখতেই শেখেননি। আর যারা এই ভদ্র পুরুষদের মধ্যে পড়েন না তারা খুব মনের ভেতর খুব সন্তর্পনে দাউদ হায়দার হয়ে থাকেন। নারীকে তারা 'ছিনাল' এর বাইরে ভাবতেই পারেন না।
শুধু যদি সাধারণ ভাষা বা শব্দগুলো দেখি তাহলেই আমাদের অতিপ্রিয় বাংলাভাষা যে কতটা পুরুষতেলানী তা স্পষ্ট হয়। অল্প কিছু শব্দ- এই মুহুর্তে যা মনে পড়ছে বলা যাক। বেশ্যা, পতিতা, ছিনাল, খানকি- বহুবছর আগে তসলিমা নাসরিন প্রশ্ন তুলেছিলেন যে এইসব শব্দের পুরুষবাচক কি? এতোবছর পরে এসেও তার উত্তর পাওয়া যায়নি। নারীরা বেশ্যা হয়েছে, পুরুষেরা কিছু হননি। একইভাবে সতী, সাধ্বী। নারীর শরীর বিষয়ক পবিত্রতার সাথে সম্পর্কিত এইসব শব্দের কোন পুরুষবাচক শব্দ হয় না। সৎ যে শব্দ ধারন করে সতী তা নয়। আবার ধরেন নটি, মাগী। 'নট' এর সঙ্গে 'রাজ' যুক্ত করে 'নটরাজ' নামের উচ্চমানের শৈল্পিক পুরুষচরিত্র দাঁড় করানো হলেও নটী মানে সেখানে বলাবাহুল্য শুধুই নটী। বিনোদিনী দাসী তাই থিয়েটারের জন্য জীবনপাত করেও নটী থেকে যান। মাগীর বিপরীত যে 'মরদ' তা বললে আমাদের চোখে ভাসে পেশীবহুল উপার্জনক্ষম পুরুষসিংহ, মাগী বললে কি ভাসে চোখে? লেখার কিছু নাই।
তো এই যে পুরুষতান্ত্রিক গড়নের ভাষা এর বিপরীতে নারীর ভাষা কি হতে পারে? নারীর জন্য আলাদা ভাষারই বা প্রয়োজন কি? নারীও কি পুরুষ ঔপন্যাসিক এর মতো লিখতে পারে, "তোমাকে এই শার্ট উপহার দিলাম, একদিন পরে দেখিও আরেকদিন না পরে?" হ্যাঁ বলতেই পারে। তাতে পুরুষের কোন সমস্যা হবে না। কারণ তাদের শরীর কোন নিষিদ্ধ বস্তু নয়। কিন্তু নারীর শরীর একটা ট্যাবু। ট্যাবু কার জন্য? নারীর শরীর ট্যাবু নারীর জন্যই, পুরুষের জন্য না। আদিকাল থেকে পুরুষেরা নারী শরীরের বিভিন্ন অংশ নিয়ে রগরগে বর্নণা দিলেও নারী তার নিজের শরীরের কথা, সেই শরীরের যন্ত্রণা, অবমান, অপমান এসব নিয়ে কিছু বলতে পারবে না। সেইসব বলার অধিকার পুরুষের একলার। এখন এইসব নিয়ে নারী কথা বললেই সে যে কত বড় চরিত্রহীন, কত বড় সমাজের আচার ভঙ্গকারী- তার ধারণা দেওয়া হয়।
নারীর লেখার জন্য নিজস্ব ভাষারীতি কেন তৈরি করতে হবে? সাহিত্যে বলেন বা দৈনন্দিন জীবনে? যদি ভাষার রাজনীতির কথা বলি, তবে নারীর পোশাকের কথাও আসে। বিশেষতঃ এই দেশে নারীর পোশাকের রাজনীতি এক বিরাট ব্যাপার। সে বিষয়ে আলাদা আলোচনার দাবী রাখে। আমি শুধু বলতে চাই, সাহিত্যে এবং দৈনন্দিন জীবনে নারীর জন্য নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি জরুরী। কারণ এই ভাষা তৈরির মধ্য দিয়ে ট্যাবু ভাঙবে। ট্যাবু ভাঙবে নারীর শরীর বিষয়ক, ট্যাবু ভাঙবে নারীর প্যাসিভ হয়ে থাকার যুগযুগান্তরের ইতিহাসের। লেখা হচ্ছে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। লেখা হচ্ছে আমাদের পরিচিত কাঠামোর বাইরের আরও অনেককিছু। নারী লিখছেন, লিখছেন, লিখছেন। ভেঙে দিচ্ছেন শব্দের পুরুষতান্ত্রিক বাঁধ। আমি আলো দেখতে পাই। আলো আসবেই। আমাদের শুধু ক্লান্তিহীন লড়াইটা জারি রাখার দায়।
লেখক: সাংবাদিক