নারীর বিরুদ্ধে যত প্রবচন
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:৩১
বাংলা প্রবাদ আসলে কি? প্রবচনই বা কি? লোকমুখে হাজার বছর ধরে চলে আসা সরেস, তীক্ষ্ম শব্দমালাকে প্রবাদ বলা যেত পারে। প্রবাদ কেন এতো জনপ্রিয় তারও কারণ আগেই ভাষাতাত্ত্বিকরা বলে গেছেন। জীবন অভিজ্ঞতার নির্যাস থাকে এতে, মানুষ তাই অর্থপূর্ণ এসব ছন্দ বা ভিন্নমাত্রার প্রকাশকে পছন্দ করে।
তো প্রবাদকে যদি জীবন অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ধরি তাহলে নারীর বিরুদ্ধে বলা প্রবচনগুলি খুবই সিগনিফিকেন্ট। প্রবাদ প্রবচন সংগ্রহ করেছেন বহু পন্ডিত বা ভাষাবিদ। প্রায় দুইশ বছর ধরে প্রবাদ সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। বাঙালিদের মধ্যে কানাইলাল ঘোষাল প্রথম বাংলা প্রবাদ সংগ্রহ করেন। এরপর বিভিন্ন সময় আরও গবেষক কাজটি করেছেন। কিন্তু শুধু নারী বিষয়ক প্রবাদ-প্রবচন সংগ্রহের তেমন কোন ইতিহাস আমি পেলাম না। সুকুমার সেন কিছু সংকলন করেছেন কিন্তু সেটা “মেয়েলী প্রবাদ” বিষয়ে। “বাংলায় নারীর ভাষা” নামে একটা প্রবন্ধে তিনি শব্দের উল্লেখ করেছেন যা থেকে পুরুষ ও নারীর সামাজিক অবস্থান স্পষ্ট হয়—যেমন: অনাছিষ্টি, লক্ষ্মীছাড়া, আটকুঁড়ো, আড়ি, আদিখ্যেতা, কটুনী, খোঁটা, গাদী, গুমর, গা, ছিরি, ঠমক, ঢঙ, দেমাক, ন্যাকা, পোয়াতি, বিয়েন, বেহায়া, কুট্টি, মিনসে, রাঁড়, রাঁড়ী, সেয়ানা, সোমত্ত, সোহাগ, সই ইত্যাদি। নারীর ক্ষেত্রে বাংলায় বিশেষ্য বাক্যাংশ এবং ক্রিয়া বাক্যাংশ প্রয়োগে কিছু স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যেমন— বিশেষ্য বাক্যাংশ—কাঁচা বয়েস, কচি খুকি, কোলের ছেলে, চোখের বালি, দাঁতে বিষ, ননীর পুতুল, নাড়ির টান, পেটের ছেলে, মাথার দিব্যি, রাঙা বৌ, হাঁড়ির খবর, পাতা কুড়নী, ঝগড়াটে, সাতে পাঁচে না থাকা, সাত পাঁচ ভাবা ইত্যাদি।
ক্রিয়া বাক্যাংশ—ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা, বানের জলে ভেসে আসা, বিয়ের ফুল ফোটা, মুখে খই ফোটা, হাঁড়িতে স্থান দেয়া, কেঁদে হাট বসানো, সইপাতানো, পাকা চুলে সিঁদুর পরা, হাঁড়ি ঠেলা, পরের মুখে ঝাল খাওয়া, মাথা কোটা ইত্যাদি।
তবে নারীর বিরুদ্ধে প্রবচন নিয়ে কেউ আলাদা করে তেমনকিছু সংকলন করেননি। নারীর বিরোধিতা বা নারীকে ছোট করে দেখার সামাজিক চোখ এইসব সংকলনে উৎসাহী নয়। বা কেউ যদি করেও থাকেন এর সামাজিক ব্যাখ্যাটা কেউ দেননি সেভাবে। কয়েকটা প্রবচন আসুন দেখে নিই।
* ভাগ্যবানের বউ মরে অভাগার গরু
* ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন যদিবা পৃথক হয়,নারীর কারণ
* পতি বিনে গতি নেই
*পতির পায়ে থাকে মতি, তবে তারে বলে সতী
* পতি হারা নারী
মাঝি হারা তরী
* পদ্মমুখী ঝি আমার পরের বাড়ি যায়
খেদা নাকী বউ এসে বাটার পান খায়
* জাতের নারী কালো ভালো
নদীর জল ঘোলা ভালো
*পুরুষ জিদে বাদশা
নারী জিদে বেশ্যা
* রান্ধিয়া বারিয়া যেইবা নারী
পতির আগে খায়
সেই নারীর বাড়িতে শিগগীর
অলক্ষী হামায়
এই কয়েকটা প্রবচন যদি বিশ্লেষণ করেন তাহলে নারীর অবস্থান এই সমাজে ঠিক কি ছিল তা ধরতে পারা যায়। অনেকে হয়তো বলবেন, এগুলো প্রাচীনকালের কথা। মধ্যযুগের এইসব প্রবচন এখন কোনমতেই রেলিভেন্ট নয়। উপরে যে প্রবচনগুলির উল্লেখ করলাম শুধু এইগুলোই যদি ব্যাখা করেন তবে দেখবেন এখনও এগুলো কতটা রেলিভেন্ট।একজন নারীর স্বামী না থাকলে সমাজে তার হেনস্থা কতটা হয় সকলেই জানি।
স্বামীর অধিনস্থ না থাকা নারীরা কি আখ্যা পায় তাও সকলেই জানি। পুরুষের জেদ কতটা প্রশংসনীয় আর নারীর জেদ কতটা নিন্দনীয় তাও জানি আমরা। না প্রবচনগুলি কেউ আর এখন গ্র্যাম্য লোকের মতো ব্যবহার হয়তো করেনা। কিন্তু “গ্রাম্যতা” যদি দোষ হয় সেই দোষে আমাদের পুরো সমাজ এখনও যথেষ্টই দুষ্ট। এখনও ফেসবুকে নারী বিষয়ক আলোচনায় এইসব প্রবাদ নানান ফর্মে ফিরে ফিরে আসে। প্রবচনগুলিরে ইলাবরেট করে সমাজ এখন। নারী তার নিজ যোগ্যতায়, “জিদে বেশ্যা” হয় এই ধরনের প্রবাদ মাথায় নিয়েও তার নিজের পথে হেঁটে গেছে। সমাজ আর রাষ্ট্র তারে কতটা সহযোগিতা করেছে আর কতটা পেছন টেনে ধরেছে সেইসব আলোচনায় না গিয়েও বলা চলে, নারী এগিয়েছে। কিন্তু প্রবচনের বিস্তারিত ব্যাখার ভাষায় সমাজ কথা বলেছে।
এখন এইসব ভাষিক রাজনীতি থেকে বা নারীর মুক্তির উপায় কি? আবহমান কাল ধরে নারীকে এমন সব অমর্যাদাকর ভাষা এবং শব্দ শুনে আসতে হয়েছে। মোকাবিলা করে আসতে হয়েছে। বিপরীতে মুখ খুললে, পুরুষের দোষত্রুটি ধরে কোন সমাজ এবং কোন নারী কোন শব্দ বা ভাষা তৈরি করলে আগের যুগে খনা আর এযুগে তসলিমা নাসরীন হতে হয়েছে। নারীর প্রতি মানবিক সম্মানবোধের জায়গাটি এই সমাজে আজ পর্যন্ত তৈরি করতে পারা যায়নি বলেই এই ধরনের প্রবচনের বিস্তৃত রূপ আজও দেখা যায়।
আশার কথা, ভাঙছে এসব। নারী কোন ভাষায় কথা বলবে, লিখবে তা যারা ঠিক করে দিচ্ছেন তাদের মুখের উপর “ঠিক করা ভাষা” ছুঁড়ে ফেলে নারী কথা বলছেন। তার মানে ধীরে ধীরে নারীর চোখ এবং নারীকে দেখার চোখ দুটোই পাল্টাচ্ছে, ধীরে হলেও। ভাবনা না পাল্টালে ভাষাও তো পাল্টায় না। প্রবচন এখন নারীই লিখবে। সমতার প্রবচন। তাতে যদি পুরুষজাতির প্রতি ক্ষোভ, রাগ, বিদ্বেষ থাকে, তাতে যদি পোড়া মরিচের জ্বালা থাকে, পুরুষ সেসব কিভাবে গ্রহণ করবে তা জানতে ইচ্ছা করে। হাজার বছর ধরে “পতি বিনে গতি” না থাকা নারীরা যখন নিজের গতি সগর্বে ঘোষণা করবে, নিরাপত্তা হীনতা বোধ করবে না তো পুরুষেরা?
লেখক: সাংবাদিক