তুসি গ্রেট হো!
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০২:০৮
ইদানীং কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। কত শত টপিক লেখার। সবাই লিখছে। আমার মাথার ভেতর ভোঁতা যন্ত্রণা। আর বুকের ভেতর কেবলি পাড় ভাঙার ভয়াবহ শব্দ। আর নিতে পারছি না ! এত অপমান আর অস্বাভাবিকতা নিয়ে একটার পর একটা মেয়ে মরছে।
যারা সইতে পারছে না, লিখছে। লিখে হয়ত কিছুটা কষ্ট বা ক্ষোভ কমছে। কিন্তু দিনের পর দিন বিচার হীনতার উদাহারণ, আমাদের আরো বেশি অনিরাপদ করে তুলছে। একটার পর একটা ঘটনা ঘটেই চলেছে। কখনো শুনছি অপরাধী ধরা পড়েছে, কখনো শুনছি পালিয়ে আছে। আবার শুনি জামিনও পেয়ে যায়। কিন্তু উপযুক্ত সাজা পেয়েছে এমনটা শুনি না কেন?
প্রতিটি ধর্ষণ ঘটনায় আমরা নারীরা যতটা উদ্বিগ্ন হই, পুরুষেরা কি সেভাবেই হন? আমি সবার কথা বলছি না। অনেকেই ধর্ষণ প্রতিরোধে নানা কিছু করার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু ঠিক যেভাবে প্রতিবাদে তাদেরও সরব হওয়া দরকার ছিল, সেভাবে কি হয়েছেন? প্রতিটি পুরুষই কারো না কারো সন্তান, বাবা, স্বামী, ভাই, বন্ধু কিংবা প্রেমিক! প্রত্যেকেই কি নিজের প্রিয় মানুষটি আক্রমণ হবার পর বিক্ষোভ আর প্রতিবাদে ফেটে পড়বেন?
আমরা নারীরা যতই চিৎকার আর চেঁচামেচি করি না কেন পুরুষ যদি প্রতিবাদে সামিল না হয় তবে আন্দোলনের সুফল পাওয়া দুর্লভ হয়ে যাবে। অনেকেই হয়ত তেড়ে আসবেন আমার কথা শুনে। কিন্তু সত্যি হল এই যে, নারী ততদিন পর্যন্ত না স্বাধীনভাবে এদেশে চলাফেরার সুযোগ পাবে, যতদিন পর্যন্ত পুরুষ তাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন করবে।
ওয়াজ হলেই শুনি, হুজুরেরা জঘন্য ভাষায় নারীদের বদনাম করে অশেষ নেকি হাসিলে নিয়োজিত থাকেন। কই কখনো তো শুনি না তাদের পুরুষের দৃষ্টি এবং লজ্জাস্হান সংযত রাখা নিয়ে কথা বলতে? কোন একটা পুরুষ কি কোনদিন প্রতিবাদ করেছেন এই এক পাক্ষিক বয়ানের? কেন করবেন? উপভোগ করতে আসলে সবারই ভালো লাগে।
আসুন কিছু ব্যাপারে সচেতন হই। আজকাল সবার বাসার নারীরা কেউ না কেউ বাইরে নিয়মিত যাতায়াত করেন। কারো স্ত্রী জব করছেন, কারো মেয়ে, আবার প্রতিটি সংসারের কেউ না কেউ স্কুল কলেজে পড়াশুনা করতে প্রতিদিন বাইরে যাচ্ছে। আমি যতদূর জানি এদেশে কেউ উদোম কিংবা আদুল গায়ে চলাফেরা করে না। আর হিজাবের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে বই কমছে না। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ এবং তারপর খুন। যদিও আমি আজো বুঝে পাইনি ছয়মাসের শিশু কিংবা দুই থেকে পাঁচ/ছ'বছরের মেয়েদের যোনীতে ধর্ষণকারী কি খুঁজে পায়!
প্রতিদিন এত এত অঘটন ঘটছে মেয়েদের সাথে, তবু মেয়েরাই বলে বসে কাপড় ঠিক ছিলনা টাইপ কথাবার্তা। অনেক রাগ আর করুণা লাগে তাদের উপর। বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলির ছবি চোখে ভেসে উঠে। ঘুমাতে পারি না। কই আমরা কি ছেলেদের আদুল গায়ে দেখলে হামলা করি? এই শিক্ষা শুধু মেয়েদের দেয়া হয় যে, লজ্জা নারীর ভূষণ। অথচ নারী পুরুষ দুজনেরই লজ্জা থাকা উচিত। পরিবারগুলিকে কিছু কিছু ব্যাপারে ছেলেদের শিক্ষা দেয়া এখন সময়ের দাবী। লজ্জা করা, নারীকে সমমান দেয়া আর বিপদে সাহায্য করার শিক্ষা দেয়া অত্যাবশ্যক। যতদিন পর্যন্ত ছেলেরা এই শিক্ষাটা না পাবে ততদিন গলা ফাটিয়ে রক্ত বের করেও লাভ হবে না।
আর সবচেয়ে জরুরি শিক্ষা হল, নারী কিংবা পুরুষ, সবাই মানুষ। মানুষ হিসাবে পরষ্পরকে গণ্য করতে না পারলে কিছুতেই নির্যাতন কমবে না। কারণ সময়ের প্রয়োজনে মেয়েরা আজ ঘরের বাইরে। দিন দিন এই অগ্রযাত্রা মিছিল বাড়বেই। পুরুষ যদি স্বাভাবিকভাবে এই অগ্রগতি মেনে নিয়ে নারীর পথ চলা সুগম করে দেয়, তবে সমাজে শান্তি আর উন্নতি অবশ্যই আসবে।
আপনি পুরুষ হোন কিংবা নারী, আপনার পুত্র সন্তানটিকে সঠিক শিক্ষা দিন। তাকে শিক্ষা দিন নারীকে যেন সে শুধু ভোগের বস্তু হিসাবে না দেখে। তাকে আরো শিক্ষা দিন, না চাইলে জোর করে যেন সে নারীকে যৌন কামনার শিকার না করে।
আমরা কি সাংবাদিকদের কাছে একটা দাবী রাখতে পারি? কেন সবসময় নির্যাতিতের আর তার পুরা পরিবারের আহাজারি আমাদের দেখতে হয়? আমরা এখন থেকে নিপীড়কের ছবি দেখতে চাই। সবসময় নির্যাতন সয়ে আবার সমাজের রোষানলে পড়ে নির্যাতিতা সহ তার পরিবার। ভালোই হয়েছে রূপাকে মেরে ফেলেছে। রূপাকে কি সুস্হভাবে আমরা বাঁচতে দিতাম? এদেশে কোন মেয়ে ধর্ষিতা হবার মানে তার পুরা পরিবার যেন মান খুঁইয়ে রাস্তায় নামা। তাই এখন থেকে এই অনুভূতির স্বীকার হোক নির্যাতকের পরিবার। তাদের দিন রাত নষ্ট হোক আমাদের সবার ঘৃণায়, ধিক্কারে। তাহলেই পরিবারগুলি এই অপরাধীদের আর ঢাল হয়ে দাঁড়াবে না। পুরা দেশবাসী যখন জানবে ঐ পরিবারের অমুক অপরাধী আর তার শাস্তি তার পরিবারও পাবে তখন এরকম অপরাধ কমবে। কারণ জাতি হিসাবে আমরা বড্ড বেহায়া! যতক্ষণ পর্যন্ত বিপদ আমাদের নিজেদের ঘাড়ে এসে না পড়ে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা শিক্ষাপ্রাপ্ত হই না। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে। উপরওয়ালার কাছে এই একটাই চাওয়া, তুমি আছো প্রমাণ দাও, এই নরাধমগুলির বিচার হচ্ছে দেখাও। দেখাও, "গড, তুসি গ্রেট হো!"
নইলে এই 'অবলা'রা যেদিন থেকে বিচার নিজ হাতে তুলে নিবে, সেদিন কিন্তু কেয়ামত আসার আগেই কেয়ামত ঘটে যাবে।
লেখক: শিক্ষক ও লেখক