উৎসব সার্বজনীন না হলে বিবর্ণ হয়ে যায়
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০১:৪৯
একটা মানুষের জন্ম কোথায়, কোন সময়, কোন পারিবারিক, আর্থসামাজিক এবং ভৌগলিক অবস্থানে তার উপরই নির্ভর করে মানুষটার 'জীবন এবং তার দর্শন' মূলত, এটা আমার বিশ্বাস। আমি জন্মসূত্রে নাদিরা সুলতানা না হয়ে হতেই পারতাম নন্দিনী ভৌমিক বা নোরা রোজারিও বা নিবেদিতা বড়ুয়া। আমি নাদিরা বলেই সারা বছর ব্যাক্তি আমি যতগুলো উৎসবের বা আচার আচরণ মেনে নেই, তার মাঝে বছরের দুইটা ঈদও থাকে।
আমি আমার বেড়ে উঠার সাথে সাথে এই বিশেষ দিনগুলো পালনে কখনই কোন বাড়াবাড়ি দেখিনি। সারা বছরের মাঝে দুইটা আলাদা দিন, চেষ্টা করা গতানুগতিকতার বাইরে আত্মীয় পরিজন পাড়া প্রতিবেশী সকল ধর্ম বর্ণ সবাই মিলেই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী মূলত একটু আনন্দে কাটানোর চেষ্টা, তাইতো দেখে এসেছি।
আমাদের পাড়ায় দুর্গোৎসবে একদিন মহিষ বলি দেয়া হতো, একদম ছোট বেলায় বড় ভাই মামা চাচাদের সাথে লুকিয়ে সেই ভীষণ উত্তেজনার মুহূর্ত দেখার জন্যে পুজা মণ্ডপে গিয়ে হাজির হয়েছি কয়েকবার। বলির দৃশ্য বলাই বাহুল্য শিশু মনের উপর একটা প্রবল ছাপ রাখার কথা। যেহেতু লুকিয়ে দেখেছি তাই বড়দের কেউ হয়তো না করার সুযোগ পায়নি।
'বলি' স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হলে সেই পূজা বাড়িতে থাকা আমার বান্ধবীদের মা, মাসী, দিদা, ফুপি, বিশেষ করে মহিলা সদস্যদের দেখেছি চিৎকার করে কাঁদতে, এ অনেকটা খুশির কান্না। মানে 'দেবী দুর্গা'কে সন্তুষ্ট করা হয়েছে, পুজা সফল হলো এমন একটা বিশ্বাস। একটু বড় হওয়ার পর, পূজার আরতি পর্ব উপভোগ করলেও, 'বলি' পর্বটা এড়িয়ে যেতাম। আরো বড় হওয়ার পর খুব কাছের বন্ধু এবং বড় ভাই সম অনেককেই দেখেছি তাদের পূজা পার্বণের নানান ছোটখাট আচার আচরণ নিয়ে নিজেরাই সমালোচনা করতে এবং আমার কাছের এমন অনেকেই অন্য ধর্মের অনেক বন্ধুই আছে নিজেদের সব বিশ্বাস অবিশ্বাস 'মিথ' নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে, নিজেদের মাঝেই ঝালিয়ে নিতে, কেন এমন, কেন এমন নয়?
এই গল্প আজ কেন বলছি? যাদের জানা নেই, তাদের জন্যে বলি, এই পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত জানা যায় প্রায় ৪২০০টা ধর্ম আছে। সব ধর্মাবলম্বীদের আছে বিশ্বাসের ভিন্নতা আছে, নানান আচার আচরণ, আছে অনেক অনেক কুসংস্কার, আছে কিছু হিংস্রতা আছে অমানবিকতাও শুধু ধর্মের নামেই। তবে মানবিক মানুষ যারা তারা বিশ্বাস করে কাউকে শারীরিক মানসিক আঘাত করে বিশ্বাসকে ভাঙ্গা যায় না। বিশেষ করে ধর্ম বিশ্বাস তো নয়ই। সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় এটি।
ধর্মীয় ইতিহাস অতীব বিস্তৃত একটি বিষয়। আপনি আমি চাইলেই এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিতে পারি না। যা পারি, মানুষকে সহিষ্ণুতা শেখাতে, মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে। সর্বোপরি ধর্মীয় আচার আচরণের মূল যদি হয় একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা তাহলেই সব ধর্মের অস্বস্তিকর বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে দিনশেষে মানুষ বোধ হয় ভুলে যেতে পারতো 'দোস্ত দুশমন' আমির ফকিরের মাঝের বৈষম্য।
সভ্য দেশে আলাদা আলাদা ধর্ম পালনে কোথাও কোন কাটাকাটির রাস্তা নেই। কারণ অনেক কিছুই দৃশ্যমান বা অন্যদের সময়কে খারাপ করে তা সচেতনভাবে সবাই মেনে চলে। দিনশেষে বিষয় হচ্ছে মানুষ সভ্য হলে তার সব প্রকাশই হবে সভ্য এটিই আমার বিশ্বাস।
বললাম এতো কথা, আজকের বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে। কেমন যেন দুইটা পক্ষের বাড়াবাড়িতে বড্ড দম বন্ধ করা হয়ে যাচ্ছে সব। খুব বেশিই যেন। 'যে কোন উৎসব আয়োজনের আনন্দ বা উপলক্ষ্য যদি সার্বজনীন না হয় আমার কাছে সেটা খুব বিবর্ণ'।
বাংলাদেশের প্রতিটি গৃহকোণ মানবিক আলোতে উদ্ভাসিত হোক, প্রাণেতে মিলুক প্রতিটি প্রাণ, যেমনটি চাওয়া ছিলো ''আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ''!!!
লেখক: প্রবাসী বাঙালি ও আরজে