আপনার আচরণ কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে না তো!
প্রকাশ : ১৯ মে ২০১৭, ০১:৩৭
আমার শৈশবে খুব প্রিয় এক বড়বোন ছিলেন। ভালো ছাত্রী। সুন্দরী সেই আপা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগে ওদের বাড়ির দোতলার বাথরুমে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। আম্মা তখন ওদের বাড়িতেই। আগুনের নারকীয় দহনের বিভীষিকা নিয়ে, জ্বলন্ত অবস্থায় সেই আপা দোতলা থেকে যখন দৌড়ে নিচে নামার পথে বারবার চেঁচিয়ে বলছেন, "আমি এ কী ভুল করলাম?" তখন হতভম্ব সবাই মিলে কম্বল, ছালা ইত্যাদি জড়িয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।
সিন্থেটিক শাড়ি পুড়ে চামড়ায় লেগে গিয়েছিলো। হাসপাতালে নেবার পথে উনি মারা যান।
প্রতিটি মানুষের জীবনেই নানাবিধ সমস্যা থাকে। যেহেতু প্রতিটি মানুষের মানসিক গঠন আলাদা, হয়তো একই সমস্যা কেউ অবলীলায় পার হয়ে যায়, কেউ হার মেনে অভিমানে, রাগে, লজ্জায় নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আত্মহননকারীকে সাহসী বলাটা ঠিক হবেনা। বরং বলা যায় বাস্তবতার মুখোমুখি হবার সামর্থ্য এদের তুলনামূলকভাবে কম অথবা ফুরিয়ে গেছে। আসলে কোন মানসিক অবস্থায় কে আত্মহত্যা করবে এটা আগে থেকে বলা মুশকিল। তবে, আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া লোকেদের মধ্যে পরবর্তীতে পুনরাবৃত্তি এবং একসময় দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলার জোরালো সম্ভাবনা থাকে।
১৯৯৩ সাল, ফ্লোরিডা। ছয় বছর বয়সী এক মেয়ের মা অসুস্থ হয়ে মারা যাবার পর শিশুটি ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে। একটি নোটে মেয়েটি লিখে গিয়েছিলো, ও মায়ের কাছে যাচ্ছে। ভেবে দেখুন, ছয় বছরের বাচ্চা একটি মেয়ে, ওর মনে হয়েছে মাকে ছাড়া ওর জীবন অর্থহীন, মায়ের সাথে ও কল্পনা করে নিয়েছে সুখময় ভবিষ্যতের, তাই মেয়েটি এই বেদনাদায়ক সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। (সূত্র: সাইকোলজি টুডে)
অথচ এই চিন্তাশক্তিই আমাদের অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা করেছে, এই কল্পনাশক্তি থেকেই রচিত হয়েছে কালজয়ী রচনা, কালোত্তীর্ণ শিল্পকলা।
প্রচণ্ড দুঃখ কষ্টের সাথে সংগ্রাম করেও মানুষ বেঁচে থাকে। এর জন্যে একটি কারণই তো যথেষ্ট, বেঁচে থাকাটা প্রায় সময়েই বেশ সুন্দর। কিন্তু অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতার বাইরের যে বিপন্ন বিস্ময় থাকে, সেটা আসলে কি!
শুধু অভাব বা দুঃখ-কষ্টের সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে আত্মহননের চেয়েও কারো যখন মনে হয়,
১) প্রিয় মানুষটি তাকে ছাড়াও বেশ থাকবে
২) পৃথিবীকে দেওয়ার মতো তার কিছু নেই
৩) সে না থাকলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে
৪) বাবা-মা অথবা প্রিয় মানুষটি সে না থাকলে বুঝবে তার কদর
৫) হতাশা
এর বাইরেও যেসব কারণ থাকে তাদের মধ্যে প্রধান হচ্ছে বিষাদময়তা। খুব প্রিয় কাউকে হারানো অথবা নিজের সীমাবদ্ধতাজনিত অসহায়ত্ব থেকে উদ্যমহীনতা পরে অবসাদের রূপ ধরে গ্রাস করতে পারে।
মানসিক ভারসাম্যহীনতাও একটি কারণ হতে পারে। বাইরে থেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক দেখতে অনেকের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা থাকা সম্ভব।
অতি মাত্রায় আবেগপ্রবণতা। মানসিকভাবে একা বোধ করা। চিকিৎসাতীত কোনো রোগের শিকার হওয়া। মৃত্যুকে শ্যামসমান ভেবে রোমান্টিকতায় ডুবে থাকা। জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ভুলের মাশুল দেবার চেষ্টা করা। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, চূড়ান্ত নেতিবাচক সিদ্ধান্তের বিষয়ে কেউ কেউ লিখে যান ‘সুইসাইডাল নোট’।
মানসিক, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক যে কোনো দিক থেকেই এই চিন্তা আসতে পারে। ব্যথা, একাকীত্ব, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, অপরাধবোধ এগুলোও কারণ হিসেবে ধরা যায়।
এর যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো একক কারণ নেই আর ঘোষণা দিয়ে সাধারণত কেউ আত্মহত্যা করতে যায়না, সেহেতু একে প্রতিরোধ করার জন্যে সবাইকেই সচেতন থাকতে হবে। বাড়ির কম বয়েসি ছেলে-মেয়েদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে, সময় দিতে হবে, লক্ষ্য রাখতে হবে, স্কুলে অথবা অনলাইনে কেউ ওদের কোনো মানসিক বা শারীরিক কষ্টের কারণ হচ্ছে কি-না, ওরা নেশায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছে কি-না, নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মানসিকতা আছে কি-না, যেমন, নিজেই নিজের হাত-পা কাটা অথবা আগুনে পোড়ানো, ডিপ্রেশনে ভুগছে কি-না, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নিজেকে অপাংক্তেয় ভাবছে কি-না, নিজের চেহারা, গায়ের রঙ নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে কি-না।
শুধু নিজের সন্তান বা ভাই-বোনের জন্যই নয়; আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিতদের ক্ষেত্রেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সময় দিতে হবে, তাদের সমস্যা মনোযোগ দিয়ে শুনে যথাসাধ্য সমাধানের চেষ্টা করতে হবে, সহমর্মিতা দেখাতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এদেরকে বিভিন্ন কাজে উৎসাহ দিতে হবে। উদ্যম ফিরিয়ে আনতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে "আমি তোমার পাশে আছি", বোঝাতে হবে, "তুমি ভালো কিছু করতে পারবে"। সামাজিকভাবে কাউকে হেয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের এই সময়ে অন্যদের সাথে কথা বলার ক্ষেত্রেও খুব সাবধান থাকতে হবে, লক্ষ্য রাখতে হবে, মানসিকভাবে কাউকে কোনোভাবে আমরা আহত করছি কি-না অথবা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছি কি-না। আমাদের একটু সহমর্মিতা হয়তো বাঁচাতে পারে একটি অমূল্য জীবন।
লেখক: সংগীত শিল্পী, মন্ট্রিয়াল, কানাডা
সূত্র: কালেরকণ্ঠ