বলতে মানা-৭
প্রকাশ : ০৫ মে ২০১৭, ০২:৫১
আমার পরিবার এবং বন্ধুদের জীবনের ঘটে যাওয়া টুকরো ঘটনা নিয়েই এই লেখা। এ লেখার পেছনের কারণ অনেক গভীর। আমি বাঙালি ‘ভাল মেয়ে’ বিশেষণের উপর বিশ্বাস হারিয়েছি বহু বছর আগে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা যা আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি এবং বারবার ভেবেছি তার কিছু অংশ এই লেখার ছোট ছোট টুকরো। কারো জীবন নয় এই সমাজ এর অনমনীয়তা তুলে ধরাই আমার লেখার উদ্দেশ্য।
আশা করি না এই লেখা পড়ে রাতারাতি সভ্য জাতিতে পরিণত হবো আমরা। তবু একজন নারীর জীবনভাবনাও যদি এই লেখার কারণে পরিবর্তন হয় তাতেও তো এ সমাজ একজন সুখি নারী পাবে। এই গল্পের সব চরিত্র এখনো বেঁচে আছেন এবং আমার বেড়ে ওঠার সময়ে এদের সান্নিধ্যে আসার কারণেই আমার জীবনধারা ব্যতিক্রম হয়েছে। যে জীবন আমার নিঃশ্বাস আটকে রাখে সে জীবন থেকে আমি নিজেকে মুক্ত করে নেই, ক্ষতি নেই যদি তা হয় স্রোতের বিপরীত।
বিঃ দ্রঃ এই গল্পের চরিত্র যদি আপনার চেনা মানুষও হন আমি অনুরোধ করবো চরিত্রকে সমালোচনার বাইরে রাখুন, তার অভিজ্ঞতা এবং এর সমাধান এর ব্যাপারে অভিমত জানান।
সময় ২০১৬
আজকাল মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না আইরিন। কখন যে শাশুড়িকে কি বলে বসে নিজেই জানে না। মা’র বয়স হয়েছে, এখনো সংসারের সবকিছু নিজের হাতেই করেন, তাতে যে আইরিনের কোন আপত্তি আছে তাও না। তবু মা কোন কথা বললেই মেজাজ চরমে উঠে যায় আর যা মুখে আসে বলে ফেলে সে। পারিবারিক মিটিং হয়, বউ-শাশুড়ির ঝগড়া মেটাতে আসে সবাই, বুঝিয়ে সুঝিয়ে চলেও যায়। তারা এক জন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেও।
মাঝরাতে উঠে আসিফকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে সে। তার অনেক অভিযোগ, “জানো আমার বিয়ের পর মা আমাকে কি বলেছে? বাসার সবার সামনে আমাকে সবসময় ধমকা ধমকি করেছে। কাজের লোকের সামনে অপমান করেছে। চাকরি করতে দেয়নি। কত ভাল ছাত্রী ছিলাম আমি। তুমি মাকে এখনি বলবে আমার এই কষ্টের কারণ তিনি"। আসিফ চোখ রগড়ে বলে, “আইরিন, সে আঠারো বছর আগের কথা! আজ সন্ধ্যায় মা তোমাকে জড়িয়ে কেঁদেছেন"। আইরিন অবাক হয়ে ভাবে, তাই বুঝি? আমার কেন মনে নেই! কেন আমার মনে হয় আমার মাথায় কাপড় সরে গেছে বলে মা আমাকে সবার সামনে বকা দিলেন! আমি কি তাহলে পাগল হয়ে গেছি!
পরদিন রাতে আইরিন পুরো ঘর পরিস্কার করে চলে, ধোয়া বাসন আবার ধোয়, গুছানো আলমারি আবার গুছায়। সামনে কেউ পড়ে গেলে তাকে ধমকে পিলে চমকে দেয়। বান্ধবিকে ফোন করে বলে, জানিস আমার না মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কত ভাল ছাত্রী ছিলাম আমি। আমাকে চাকরি করতে দিল না। আমার খুব কলেজের কথা মনে পড়ে। সবাইকে ফোন করি, অনেকেই বিব্রত বোধ করে, সময় নেই কিনা। আমার তো অনেক সময়, ছেলেরা স্কুলে গেলে আমি কলেজের কথা ভাবি। আমার ছেলেদের আমি অনেক ভালবাসি, কিন্তু আমার খুব একা লাগে। আসিফ আমাকে ডাক্তার দেখিয়েছে, সেও আমাকে অনেক ভালবাসে। আমার মনে হয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে, খালি মেজাজ চড়ে যায়।
আজকাল প্রায় রাতেই আইরিন আসিফকে ঘুম থেকে তুলে আঠারো বছর আগের ‘শাশুড়িকথন’ শুনায়, সব অভিযোগ যা আঠার বছর আগে ‘আঠারো’ বছর বয়সি মেয়েটা করতে পারেনি তা ‘ছত্রিশ’ বছর বয়সে করে। আসিফ নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকালে অফিসে যায়, আইরিন ভুলে যায় যে সে অতীতের মাঝে বাস করে। আসিফও মনে হয় পাগল হয়ে যাবে।
(চলবে...)
লেখক: গবেষক