এ-ই আমার সত্যি, এ-ই আমার শক্তি
প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৭:৫৫
মুনার একলা বাঁচার গল্পটা পড়ে কিছুক্ষণ আগে একজন কথা বলতে চাইলো। নাম্বার দিতেই ফোন করলো। কিন্তু কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিলো না। কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলো মেয়েটি। শুধু বলতে পারলো, "আপা, কোন কোন সময় একটা লেখা মানুষের জীবন বাঁচায়, আজকে ঠিক এই সময়ে আপনার লেখাটার কারণে আমি বেঁচে থাকলাম, আমি ভালো থাকতে পারবো আজকের দিনটি"...আমি কিছু বলতে পারিনি, আমি শুধু মেয়েটার হাত ধরে একটু বসে থাকতে চেয়েছিলাম। পারিনি...। মেয়েটা কাঁদার সময় চেয়েছে। সে বলেছে সে একটু সামলে নিয়ে আমাকে ফোন করবে। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য, মেয়ে।
নারীবাদের ইজারা নেওয়া বিশেষজ্ঞরা শুনুন, আমি গ্রামের অশিক্ষিত নারী। আপনাদের ওই দাস ক্যাপিটাল পড়া আর স্টাডি সার্কেলে তত্ত্ব কপচানো নারীবাদ আমি বুঝি না। আপনারা অবতার হয়ে ঐশিগ্রন্থের মতো উচিত অনুচিতের বর্ডার দেন যে নারীবাদে, সে বর্ডারের কাঁথা বালিশ সব পুড়ি আমি। আমার নারীবাদ কেডসে থাকে না, বইতেও থাকে না। নারীবাদ আমার জীবনে থাকে, ওই মেয়েটির বঞ্চনার বেদনাকে অনুভব করতে পারায় থাকে, প্রতিবাদের ভাষায় থাকে, শৃঙ্খল ভাঙ্গার সুরে থাকে। আমার নারীবাদ তাই আপনার ওই পুরুষের ভাষায় আওড়ানো বুলিকে চ্যালেঞ্জ করে। আমার কাছে আপনি পুরুষ শভেনিষ্ট এর নারীরূপ ছাড়া আর কিছুই নন।
নারীবাদ আমার একান্ত ব্যক্তিগত লড়াই। যেদিন কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে আমার বাবাকে নিগৃহীত হতে দেখতে দেখতে আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম দাদার, সেদিন থেকেই এই লড়াই এর শুরু হয়েছিলো। যেদিন এই সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একলা পথে নেমে এসছিলাম ভুল সম্পর্কের বেড়াজাল কেটে, সেদিনই আমি নারীবাদের মন্ত্র শিখেছিলাম আমার জীবনের তত্ত্বে। আপনাদের ওই বস্তা পঁচা বই পড়া তত্ত্বের দু'আনা দামও আমার কাছে ছিলো না সেদিন, আজো নেই। আমার তত্ত্ব আমার জীবন থেকে নেয়া, ওই মেয়েটির অশ্রুজলে লেখা, স্বামীর মার খেয়ে ফুঁসে ওঠা মর্জিনার ক্ষোভের আগুনে জ্বলা। যে মেয়েটি সতের বছর বয়স থেকে স্বামীর মার খেতে খেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে একলা জীবনের যুদ্ধে নেমেছে তার কন্যা সন্তানকে নিয়ে, সেই মেয়েটি যখন বলে আমার লেখা তাকে শক্তি দেয়, আমার কাছে মেয়েটির সেই শক্তির নামই নারীবাদ।
নারীবাদ আমার কাছে ওই মেয়েটির জন্য একটি লেখা, যে লেখা পড়ে মেয়েটি মন খুলে কাঁদলো। যে মেয়েটি জীবন হারাতে হারাতে নিজেই হারিয়ে যাচ্ছিলো, সে মেয়েটিকে জীবনে ফিরিয়ে আনার এই লড়াইটা একান্তই আমার নিজস্ব। আমার কৌশল ও আমারই একান্ত। আপনাদের এই বৃথা তত্ত্বের আস্ফালন আমাকে জানিয়ে দিলো, দিনের শেষে এই তত্ত্ব না জানা নারীর শক্তি আপনাদের ম্যাটার করে, তাই আমি যেমন পুরুষের কাছে অসহ্য, ঠিক তেমনই আপনাদের মতো নারীর কাছেও। আমি একা লড়তে জানি, একা লড়তে পারি বলেই আপনাদের কাছে কখনো তা 'হেডম' মনে হয় বৈকি। কিন্তু এ-ই আমার সত্যি, এ-ই আমার শক্তি।
সাদিয়া নাসরিন এর ফেসবুক থেকে